
২০১৬ সালের বিপর্যয়ের পর অধিকাংশ রাজনৈতিক ভাষ্যকার বিশ্বাস করেন উদার (Liberal) বিশ্বব্যবস্থা গুরুতর ঝামেলার মধ্যে আছে। সম্প্রতি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে দেখা গেল, জার্মান চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াঙ ই, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ উদার ব্যবস্থা কী জিনিস, তা নিয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেননি। ফলে এই ব্যবস্থার কী হবে, তা বলা কঠিন।
যখন পশ্চিম ও বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে ছড়ি ঘোরাত, তখন উদার ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা যা বলত, ব্যাপারটা সেরকমই ছিল। অন্যান্য দেশ এ নিয়ে নানা অভিযোগ করত। তারা বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলত। কিন্তু তারা মূলত পশ্চিমাদের বেঁধে দেওয়া নিয়মই মেনে চলত।
বৈশ্বিক ক্ষমতা যেহেতু পশ্চিমের কাছ থেকে ‘বাকিদের’ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, তাই উদার বিশ্বব্যবস্থার ধারণা ক্রমবর্ধমান হারে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো উদীয়মান শক্তিগুলো পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জ করছে।
উদার বিশ্বব্যবস্থা একেবারেই অস্পষ্ট ধারণা, তা বলা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছাইয়ের মধ্য থেকে ‘উদার ব্যবস্থা ১.০’ গড়ে ওঠে, যার লক্ষ্য ছিল শান্তি সমুন্নত রাখা ও বৈশ্বিক সমৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগানো। ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, যেটি পরে বিশ্বব্যাংকে রূপান্তরিত হয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও তার সঙ্গে ন্যাটোর মতো আঞ্চলিক নিরাপত্তা বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থা আরও পাকাপোক্ত হয়। এটা জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বহুপক্ষীয় বন্দোবস্তে জোর দেয়, যার মাধ্যমে মুক্তবাণিজ্যের পক্ষেও জোর প্রচার দেওয়া হয়।
কিন্তু উদার ব্যবস্থা ১.০–এর সীমাবদ্ধতা আছে, অর্থাৎ সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমান্ত। যত দিন পরাশক্তিসমূহের দ্বন্দ্বকে আক্রান্ত করেনি তত দিন প্রতিটি দেশ মূলত নিজ ঘরে ব্যবসা করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিজয়ী পশ্চিমা শক্তি উদার বিশ্বব্যবস্থার সীমা সম্প্রসারিত করেছে। ফলে হলো কী, দেশে দেশে উদার বিশ্বব্যবস্থা ২.০-এর অনুপ্রবেশ ঘটল, যার লক্ষ্য হলো, সংশ্লিষ্ট দেশে বসবাসরত মানুষের অধিকার প্রাধান্য দেওয়া।
এই সম্প্রসারিত ব্যবস্থা যেকোনো মূল্যে জাতীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত না রেখে বরং পুরো ব্যাপারটা একাকার করে এমন এক অভিন্ন নিয়ম বানানোর চেষ্টা করল, যা সব জাতীয় সরকারের মেনে চলা উচিত। এই উদার ব্যবস্থা ২.০ নানাভাবেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) জাতীয় সংস্থাকে জোরদার করেছে। একই সঙ্গে, রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট (আরটুপি)-এর মতো নতুন মূল্যবোধকেও শক্তিশালী করেছে, যা পৃথিবীকে পশ্চিমের আদলে গড়েপিটে নিতে চেয়েছে।
কিন্তু চীন ও রাশিয়ার মতো সার্বভৌমত্ববাদী শক্তিগুলো এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়। অন্যদিকে পশ্চিমা নীতিপ্রণেতারা যেসব দুর্যোগসম ভুল করেছিলেন যেমন, ইরাকের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে উদার ব্যবস্থা ২.০–এর মোড় ঘুরে যায়। ওদিকে পশ্চিম যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, এখন সে নিজেই তা ছুড়ে ফেলছে। সে উদীয়মান শক্তিগুলোর মতো সার্বভৌমত্বের ধুয়া তুলছে। যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুক্তবাণিজ্য ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তির নিন্দা—এসব কারণে অধিকতর মৌলিক উদার ব্যবস্থা ১.০ হুমকির মুখে।
অনেকেই দাবি করেন, পশ্চিম উদার ব্যবস্থা ২.০ তৈরি করতে গিয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েছিল। ফলে সে নিজের স্বার্থই ক্ষুণ্ন করেছে। কিন্তু ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখনো ১.০ প্রয়োজনীয়। এটা যে বহুপক্ষীয় বন্দোবস্তে জোর দেয়, সেটাও তার দরকার। অন্যথায় সে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও অতীতের শত্রুর সমন্বয়ে গঠিত নতুন ধরনের এক বিশ্বায়নের মুখোমুখি হতে পারে।
ইন্টারনেট, অভিবাসন, বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়ন—এগুলো বৈশ্বিক আইনে কার্যকরভাবে পরিচালিত হওয়ার আগে নতুন যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিচালিত হবে মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাধ্যমে, যা ক্রমবর্ধমান হারে মর্যাদাবিষয়ক উদ্বেগ, প্রতিষ্ঠানের প্রতি অবিশ্বাস ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত হবে।
বিষয়টি হচ্ছে, ইউরোপীয় সরকারগুলো কীভাবে এই নতুন বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলার জবাব দেবে, সে ব্যাপারে তারা এখনো অনিশ্চিত। এর সম্ভাব্য তিনটি কৌশল আছে। প্রথমত, জার্মানি নিজেকে উদার বিশ্বব্যবস্থার দায়িত্বশীল অংশীজন মনে করে, ফলে তাকে এই ব্যবস্থার প্রধান পুরোহিত হতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সে বৈশ্বিকভাবে উদার ব্যবস্থা ১.০ সমুন্নত রাখতে কাজ করবে, যেখানে সে উদার ব্যবস্থা ২.০ ইউরোপের মধ্যে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয় কৌশলের বাস্তব রূপ দেখিয়েছে এরদোয়ানের নেতৃত্বে আজকের তুরস্ক, যাকে মুনাফা সর্বোচ্চ করার নীতি বলা যায়। তুরস্ক বিদ্যমান ব্যবস্থাকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছে না। কিন্তু এটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্বও সে বোধ করছে না। বরং সে পশ্চিম-নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো থেকে যতটা নেওয়া যায়, তার চেষ্টাটাই করছে। আবার সে রাশিয়া, ইরান ও চীনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে এমন সম্পর্কে আসার চেষ্টা করছে, যাতে সবারই উপকার হয়।
তৃতীয় কৌশলটি একদম সাদামাটা ভণ্ডামি। সেটা হলো, ইউরোপ কথা বলবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের মতো, কিন্তু কাজ করবে মুনাফা সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন, তখন তিনি এ অবস্থানই নিয়েছিলেন। তিনি ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মুক্তবাণিজ্য নিয়ে ভালো ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে এই কাঠামোর বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ চুক্তির জন্য দেনদরবার করেছেন।
কথা হচ্ছে, পশ্চিম সম্মিলিতভাবে এই উদার ব্যবস্থা ১.০ টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু তারা এখান থেকে কী চায় বা এটা টিকিয়ে রাখায় তাদের দায়িত্ব কী—সে বিষয়ে একমত হতে না পারলে তারা সম্ভবত এ ব্যাপারে চেষ্টাও করবে না।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
মার্ক লিওনার্ড: ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক।