উন্নয়ন কি কুড়িগ্রামেরও নয়?
খানা জরিপে এই প্রথমবারের মতো জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের হিসাব করা হলো। পূর্বধারণা অনুযায়ী জানা গেল, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা হচ্ছে উত্তরের কুড়িগ্রাম, যেখানে দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে কুড়িগ্রামের রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি আগামী বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। রংপুর বিভাগের অন্যান্য জেলার অবস্থাও তথৈবচ। অন্যদিকে, দেশে দারিদ্র্যের পরিমাণ সবচেয়ে কম ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জে, ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সমীকরণটা খুব পরিষ্কার, যেখানে শিল্পায়ন হয়েছে, সেখানে দারিদ্র্যের হার কম। উত্তরাঞ্চলের এই জেলাগুলো মঙ্গার হাত থেকে রেহাই পেলেও দারিদ্র্যের করাল গ্রাস থেকে এখনো পায়নি। সারা পৃথিবীতে যেমন মানুষের আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে, তেমনি আঞ্চলিক বৈষম্যও বেড়েছে।
রংপুরের মানুষ চিরকালই অবহেলিত। সেখানকার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করতে গেলে তাঁদের ‘মফিজ’ বলা হয়। সহজ-সরল মানুষগুলোর ভাগ্যে আর যা-ই জুটুক না কেন, এই খেতাবটা দ্রুত জুটে যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে শাড়ির অভাবে গায়ে জাল পেঁচিয়ে রাখা সেই বাসন্তীও কিন্তু কুড়িগ্রামের চিলমারীর মানুষ। অথচ দেশের সাবেক একজন প্রেসিডেন্টের বাড়ি রংপুরে, আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়িও সেখানে। তাঁরা দুজনই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় শাসন করেছেন এবং করছেন।
কুড়িগ্রামে যেহেতু দারিদ্র্যের হার বেশি, সেহেতু সেখানে শিশুদের অপুষ্টি ও খর্বাকৃতির হারও অনেক বেশি। একই কারণে সেখানে মানুষের রোগবালাইও বেশি হয়। সেখানে পড়াশোনার হারও স্বাভাবিকভাবেই কম। এই দারিদ্র্য মানুষের বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় যেখানে গড় পুষ্টিহীনতার হার ৩৫ শতাংশ, সেখানে কুড়িগ্রামে তা ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। ২০টি নদ-নদী থাকার পরও সবচেয়ে কম মাছ ভোগ করে এই জেলার মানুষই। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় জনপ্রতি মাছ গ্রহণের হার যেখানে ১২ কেজি, সেখানে কুড়িগ্রামে তা সাড়ে ৭ কেজি।
কুড়িগ্রামের ২০টি নদ-নদীর গর্ভে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য চর। এই চরে নানা জাতের ডাল ও বীজের চাষ হয়। চরের মাটি উর্বর হওয়ায় এখানে ফসল উৎপাদনের হারও অনেক বেশি। অথচ এই চরের প্রান্তিক মানুষ কৃষিঋণ বা সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পান না। অন্য কথায়, তাঁরা জানেনও না, সরকার কী জিনিস। মূলত, সরকারদলীয় লোকজনই এসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ ডালবীজ উৎপাদনে কৃষিভিত্তিক বড় বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। আমাদের খাদ্যবৈচিত্র্যের ঘাটতি মেটাতে এটা সহায়ক হতে পারে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে চরের লোকজন ফসলের ভালো দাম পাবেন, যার বদৌলতে তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তাঁদের দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনতে এমন উদ্যোগের প্রয়োজন। অন্যদিকে, বিপুলসংখ্যক নদ-নদী থাকায় এখানে পর্যটনের সুযোগও আছে, বিশেষ করে চিলমারীর কথা বলা যায়, সেখান থেকে ব্রহ্মপুত্রের ওপারে আসাম অঞ্চলের পাহাড় দেখা যায়; তাই এ জায়গা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী গত বছর কুড়িগ্রাম সফরের সময় অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চিলমারীতে নদীবন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সারা দেশেই অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মিত হচ্ছে। তার সঙ্গে কুড়িগ্রামেও যদি একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হয়, তাহলে একদিকে এখানকার মানুষের ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রয়োজন হবে না, অন্যদিকে স্থানীয় অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চারিত হবে। চিলমারী বন্দর নির্মিত হলে সেখান থেকে আসামে যাওয়া-আসা সহজ হবে। আর এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে যদি আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদন করা যায়, তাহলে কি কুড়িগ্রাম আর গরিব থাকবে? কানেকটিভিটি বা যোগাযোগের এই যুগে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব।
জেলার রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি টানা পাঁচ বছর ধরে জেলার দুর্দশার সমাধানে নানা প্রস্তাব দিয়ে আসছে। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, চিলমারী থেকে ঢাকা পর্যন্ত ‘ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস’ নামে আন্তনগর ট্রেন, প্রস্তাবিত চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ তিস্তা সেতুর নকশায় রেল যুক্ত করা, ঐতিহাসিক চিলমারী নদীবন্দর পুনরায় চালু করা এবং রৌমারী-রাজীবপুর থেকে চিলমারী রুটে ফেরি যোগাযোগ চালু করলে কুড়িগ্রাম জেলা আপনা–আপনি এগিয়ে যাবে।
নাহিদ হাসান আরও বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার কারণেই কুড়িগ্রাম জেলা এককালে আসাম-পূর্ব বাংলার দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেশভাগের পর কুড়িগ্রাম জেলা পৌনে শতবর্ষ ধরে যে বিচ্ছিন্নতায় ডুবে আছে, এই যোগাযোগব্যবস্থাই তাকে সেই বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি দেবে। দূর হবে দারিদ্র্য।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।