উন্নয়ন দর্শনে ভুলের মাশুলই কি দিতে হচ্ছে

বহুতল ভবনের পাশেই বস্তি। আমাদের উন্নয়ন দর্শনের বড় এক গলদ
ছবি : প্রথম আলো

ধনসম্পদ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির শিখরে পৌঁছেও পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে শান্তি আজ পান্ডার মতো বিলুপ্তপ্রায়। অন্যভাবে বলা যায়—উন্নতির পারদ যতই ওপরে উঠছে, শান্তির পারদ ততই নিচে নামছে। ধনসম্পদের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো পরিবারেও আজ শান্তির দেখা পাওয়া ভার। তাই মর্ত্যের শান্তির আশা ছেড়ে দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা আজ মহাকাশে শান্তির আশায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ধনীরা শান্তির খোঁজে বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা পাচার করে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাতে ব্যস্ত। অথচ পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা এবং অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। কোটি কোটি শিশু আজ অপুষ্টিতে জরাজীর্ণ এবং শিক্ষাবঞ্চিত। আর এগুলো কি এই তথাকথিত উন্নয়নের প্রতিফল নয়? তাহলে নিশ্চয়ই উন্নয়নের প্রচলিত দর্শনে কোথাও গলদ আছে।

উন্নয়ন ধারণায় বা উন্নয়ন তত্ত্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন, মানুষের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণসহ নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। আর এসব ধারণার নির্যাস বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পরিমাপযোগ্য তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করে। আর তা হলো সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন; যা প্রত্যাশিত গড় আয়ু দিয়ে মাপা হয়, জ্ঞান; যা পড়াশোনার বছর দিয়ে পরিমাপ করা হয় এবং স্বাচ্ছন্দ্য জীবনমান; যা মাথাপিছু গড় আয় দিয়ে মাপা হয়। তবে কোথাও শান্তির বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ নেই।

একটু ভাবুন তো, আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে যদি উন্নয়নের দর্শনে সামগ্রিক কল্যাণসাধনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো, তাহলে পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো। আর সামগ্রিক কল্যাণ মানেই তো সবার সন্তুষ্টি। আর সবার সন্তুষ্টি অর্জনই যদি লক্ষ্য হতো, তাহলেই নিশ্চয়ই সম্পদশালীরা অতি ভোগ-বিলাসিতার পরিবর্তে মানবকল্যাণে সর্বদা সচেষ্ট হতো।

অন্যদিকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন ধারণার ১৭টি অভীষ্টে মানবকল্যাণসহ অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হলেও শান্তির বিষয়ে সরাসরি কিছুই বলা হয়নি। তবে শান্তির বিষয়টি উন্নয়ন ধারণায় একেবারে উপেক্ষিত—তা কিন্তু নয়। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন এবং ভুটানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিগমি থিনলের উদ্যোগে ২০১১ সালে যে বিশ্ব সুখের সূচক তৈরি করা হয়, সেটাই সুখ বা শান্তি পরিমাপের প্রথম কোনো উদ্যোগ। তবে উন্নয়ন ধারণায় কিংবা সূচকে সুখ বা শান্তির স্থান কিছুটা ঠাঁই পেলেও বাস্তবে তো শান্তির দেখা নেই।

মূলত পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে ইউরোপে রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে প্রথমে ইউরোপ এবং পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সর্বত্র আধুনিক উন্নয়নের যে ধারা চালু হয়, সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি আত্মকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ এবং ভোগবাদকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সামগ্রিক কল্যাণের পরিবর্তে সর্বত্র আজ আত্মকেন্দ্রিকতাই স্থান পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, নীতিনৈতিকতা এবং ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার না করে যেকোনো মূল্যে ধনসম্পদ উপার্জনই মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এ কারণে একশ্রেণির মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আরেক শ্রেণি দিনরাত খেটেও দুই বেলা অন্নের সংস্থান করতে পারছে না। তাই বিশ্ব আজ ক্ষুধা-দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জুলুম-নির্যাতন, মারামারি, হানাহানিসহ নানা অশান্তিতে জর্জরিত।

একটু ভাবুন তো, আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে যদি উন্নয়নের দর্শনে সামগ্রিক কল্যাণসাধনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হতো, তাহলে পৃথিবীটা কত সুন্দর হতো। আর সামগ্রিক কল্যাণ মানেই তো সবার সন্তুষ্টি। আর সবার সন্তুষ্টি অর্জনই যদি লক্ষ্য হতো, তাহলেই নিশ্চয়ই সম্পদশালীরা অতি ভোগ-বিলাসিতার পরিবর্তে মানবকল্যাণে সর্বদা সচেষ্ট হতো।

আর এই আত্মকেন্দ্রিকতার মূলেই রয়েছে সম্পদের মালিকানার বিষয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই সম্পদের মালিক। ফলে ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টির প্রয়াস থাকে না। আবার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ বহু মৌলিক অধিকার খর্ব হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টিরও সুযোগও নেই। তদুপরি ক্ষমতাসীনদের জুলুম এবং দমন-নিপীড়ন তো আছেই। তাই সমাজতন্ত্র পৃথিবী থেকে কার্যত বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাদে ব্যক্তিই সম্পদের মালিক। এই অধিকারবোধই তাকে সম্পদ অর্জনে অনুপ্রেরণা জোগায়। পাশাপাশি ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকার সুবাদে তার সম্পদ অর্জন এবং ভোগের পথে কোনো বাধা থাকে না। এই দুয়ের সম্মিলিত শক্তিতে পুঁজিপতি ফুলেফেঁপে ওঠে। আর এটাই বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা। তাই এই করোনা মহামারিকালেও সুযোগসন্ধানী পুঁজিবাদের উত্থান লক্ষণীয়। তবে পুঁজিবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পদ বৃদ্ধির প্রয়াস এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বেশ কিছু ভালো দিক থাকায় তা এখনো টিকে আছ। কিন্তু বর্তমানে এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা বিকল্প না থাকায় তা দানব থেকে অতি দানবীয় রূপ গ্রহণ করেছে। করোনা মহামারির উত্থান এবং টিকাবাণিজ্যেও বিশ্বের শীর্ষ পুঁজিপতিদের কারও কারও হাত আছে বলে একটি মত প্রচলিত আছে।

তাই সময় থাকতে পুঁজিবাদের বিকল্প খুঁজে বের করতে না পারলে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়াবে, যখন জীবিত মানুষেরা মৃত মানুষকেই বেশি সৌভাগ্যবান হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে? পৃথিবীতে এ বিষয়ের দার্শনিকের আজ বড়ই অভাব। দু-একজন যাঁরা আছেন, তাঁরাও পুঁজিবাদের প্রভাবে মুক্তচিন্তা এবং সর্বজনীনতার পরিবর্তে সংকীর্ণতায় ডুবে আছেন। তবু প্রত্যাশা করি, শিগগিরই এমন কারোর আবির্ভাব হোক, যার নেতৃত্বে আত্মকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ এবং ভোগবাদের দর্শন বিলুপ্ত হয়ে সামগ্রিক কল্যাণসাধনের পথ সুগম হবে।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়