উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু কতটুকু?

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের চিলমারীর এক যুগ নামের একটা বই আছে। সে বইতে তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত চিলমারীর উন্নয়নের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। মোনাজাতউদ্দিন ১৯৮২ সালে পত্রিকায় কুড়িগ্রাম-চিলমারী রেল যোগাযোগ নিয়ে সেই সময়ে ছাপানো একটি কার্টুনের বর্ণনা দিয়েছেন। ট্রেনে না উঠে বুড়ির হেঁটে যাওয়ার কার্টুনটি তাঁর ভাষায়, ‘বুড়িমা, হেঁটে যাচ্ছ কেন? ট্রেনে উঠে এসো। বুড়ি বলছেন, আমার সময় কম বাবা, তোমাদের আগেই আমাকে চিলমারীতে যেতে হবে।’ ১৯৯৪ সালের রেল যোগাযোগ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘এক যুগ পরেও ওই কার্টুনটি ছাপা চলে।’ ওয়ার্কশপে নেওয়ার মতো অবস্থা নেই এমন ট্রেনগুলো দেওয়া হতো এ লাইনে। ১৯৮২ সালের আর একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন মোনাজাতউদ্দিন। কুড়িগ্রাম থেকে চিলমারী যাওয়ার জন্য আধা ঘণ্টা আগে স্টেশনে গিয়ে শোনেন যে ট্রেন চলে গেছে। পরে তিনি জানতে পারেন, আগের দিনের ট্রেনটি পরের দিন ট্রেন ছাড়ার আধা ঘণ্টা আগে এসেছিল।

মোনাজাতউদ্দিন ১৯৯৪ সালে এ কথাগুলো লিখেছেন। তারপর প্রায় দুই যুগ হতে চলল, কিন্তু রেল–ব্যবস্থার উন্নয়ন কি হয়েছে? যে কার্টুনটি এক যুগ পরে ছাপানোর কথা বলা হয়েছে, সেই কার্টুনটি ধাঁধা আকারে যদি এখন পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করা যায়, এ দৃশ্যটি দেশের কোথাকার? তাহলে সহজেই এর জবাব হবে রংপুর-কুড়িগ্রামের। ট্রেন ছাড়ার সময়সূচিও আগের বাস্তবতায়। এখনো এই পথে যে ট্রেনগুলো চলে, সেগুলো ওয়ার্কশপে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।

১৯৯৪ সালে খবর সংগ্রহ করে চিলমারী থেকে ফেরার সময় মোনাজাতউদ্দিন সড়কপথের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি বিরাট জটলা। আরও কিছু মজুর। একদলা। ইতিমধ্যেই উঠে পড়েছেন বাসের ছাদে। তাঁদের দড়ি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে, যাতে পড়ে না যান।’ ১৯৯৪ সালের পর আরও ২২টি বছর চলে গেছে। এখনো রংপুরের মডার্ন মোড় এলাকায় এসে দাঁড়ালে শত শত বাসে ছাদভর্তি মানুষ দেখা যায়। উন্নতি শুধু এতটুকু হয়েছে—আগে মানুষগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেওয়া হতো, আর এখন দড়ি দিয়ে বেঁধে নেওয়া হয় না। কারণ তারা এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। জীবনের মূল্যের চেয়ে কয়েকটি টাকার মূল্য তাদের কাছে অনেক দামি।

১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারকে ভীষণভাবে বিব্রত করেছিল দুর্ভিক্ষের শিকার বাসন্তী ও দুর্গতির জাল পরা ছবি। পরে জানা যায়, একজন ফটো সাংবাদিক জাল পরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। ওই ছবিটি মিথ্যা হলেও তাদের জীবনযাপনের কষ্ট কম ছিল না। ১৯৭৪ সালের সেই সময় থেকে ৪২ বছর পরের বাসন্তী পরিবারের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কয়েক দিন আগে গিয়েছিলাম বাসন্তীদের গ্রামে। চিলমারীর অনেকেই জেলেপাড়া নামের পরিবর্তে বাসন্তীর গ্রাম বললেই যেন বেশি চেনে। বাসন্তীর বাড়িতে গিয়ে জানলাম, বাসন্তী তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত। তাঁর ভাইয়ের পরিবারের তিনবেলা খাবার জোটে না। কথা হলো প্রৌঢ় পূর্ণিমার সঙ্গে। তিনি তাঁর দুঃখের কথা শোনালেন। পূর্ণিমার স্বামী ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চার সন্তানসহ বউকে ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। আর কোনো দিন ফিরে আসেননি। পূর্ণিমারা দুর্ভিক্ষের সময় কচুর শিকড় খেয়েছিলেন। মুখ পুড়ে যেত, তবু ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে খেয়েছিলেন। ৪২ বছর পর তাঁর কচুর শিকড় খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তবে অন্যের বাড়িতে খাবার চেয়ে নিয়ে খেতে হয় পূর্ণিমাকে।

ব্রহ্মপুত্রের তীরে কথা হলো মহিষের গাড়ির এক গাড়িয়ালের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘২০ বছর আগে তিনবেলা খাবার পাই নাই। এলা তিনবেলা ভাত খাইতে পারি।’ লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১ এপ্রিল তাঁর জন্মজেলা কুড়িগ্রাম সম্পর্কে বলছিলেন, ‘কুড়িগ্রামের হাটগুলোতে আগে নেংটি পরা ও খালি পায়ের অসংখ্য মানুষ দেখা যেত। এখন আর সেসব নেই। তবে উন্নয়ন যতটুকু হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি।’

আমাদের দেশে যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকেন, তাঁরা কি এসব অঞ্চলের উন্নয়নের কচ্ছপ গতি সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন? সময় আগের মতো নেই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তন দেশের সব এলাকার মধ্যে সুষম হয়নি। রংপুর অঞ্চলের মানুষের পরিবর্তন তখন বোঝা যায়, যখন তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন ধরে মানুষ পুড়ে যায়। দেখা যায় সেই মানুষের বড়সংখ্যক রংপুরের। আবার যখন রানা প্লাজা ধসে পড়ে শ্রমিক মারা হয়, তখন দেখা যায় তাঁদের অধিকাংশই রংপুরের। এতে করে বোঝা যায় রংপুরের মানুষ জাতীয় পর্যায়ে কত বড় অবদান রাখছে, আর তাদের জীবনের মূল্য কত কম। এখানকার শ্রমজীবীরা বিদেশ বলতে ঢাকাকেই বোঝেন। আমরাও বলে থাকি, রংপুরের মানুষের রেমিট্যান্স বলতে পোশাক কারখানার কর্মীদের বিকাশের মাধ্যমে পাঠানো টাকা। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়ন হয় ডলারে আর রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন হয় সিকি-আধুলিতে।

সরকারের যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখছেন, তাঁদের উচিত রংপুর বিভাগের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া। এ অঞ্চলের বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে তোলার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সে জন্য পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আনার ব্যবস্থা করতে হবে অথবা কারখানাগুলোতে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ দিতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নদীগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হবে। নদী বাঁচাতে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এগুলোর অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশেষ প্রচেষ্টা থাকা ভীষণ জরুরি।

‘ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বিক্রি’, কিংবা ‘মাও লক্ষ্মী এক মাস থাকি বাড়িত নাই’—এ ধরনের অভাবী বাস্তবতা এখন নেই। তিনবেলা খেতে পাওয়ার বাস্তবতা অনেকখানি তৈরি হয়েছে। কিন্তু দেশের গড় উন্নয়নের সঙ্গে কি রংপুরের উন্নয়ন সমান হয়েছে?

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর