পাঁচজন জনপ্রতিনিধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি উপজেলা পরিষদ নিয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মো.কামরুল হোসেনের বেঞ্চ থেকে ৬ জানুয়ারি জারি করা উপজেলা পরিষদ আইনের ‘ধারা ৩৩ কেন অসাংবিধানিক হবে না’ এ মর্মে রুল জারি করা হয়। সরকার এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘উপজেলা পরিষদ কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিধিমালা-২০১০’ সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও মাঠে তা কার্যকর হচ্ছে না।
এ বিষয়ের এক সম্পূরক শুনানিকালে রুলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি বিভাগের নথিপত্র নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপনের আদেশ দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতে ১৫ জুন দায়ের করা অপর এক রিটের আদেশে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান উপজেলা পরিষদ ভবনের ‘সাইনবোর্ড’ যথাযথভাবে লেখা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও নিরাপত্তা দেওয়ার আদেশ দেন। এ দুটি আদেশ উপজেলা পরিষদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতা ও সম্মান পুনরুদ্ধারে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে উপজেলা পরিষদ তথা এ মধ্যবর্তী স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটি নামে বহাল থাকলেও কার্যত অচল।
তাই পূর্ণাঙ্গ শুনানির পর উচ্চ আদালতের এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আদেশ আশা করি স্থানীয় সরকার বিষয়ে সংবিধানের অঙ্গীকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। শুধু উপজেলা পরিষদ নয়, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, কোনো ক্ষেত্রেই আইন করা ও আইন কার্যকর করা, উভয় ক্ষেত্রে পদে পদে সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাই উপজেলা পরিষদ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ রায় অপর প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও যুগান্তকারী নজির হিসেবে প্রতিভাত হবে আশা করা যায়।
২০২১ সালের ৭ নভেম্বর উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থার ৩৯ বছর পূর্ণ হবে। বর্তমান পরিষদের অকার্যকারিতার উপাদানগুলো সবার মোটামুটি জানা থাকলেও সমাধানের উদ্যোগ নেই। প্রথম ও প্রধান কারণটি ‘রাজনৈতিক’। উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮–এর ধারা ২৫ (১) বলে প্রতিজন জাতীয় সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকার উপজেলা পরিষদের ‘উপদেষ্টা’। পৃথিবীর কোথাও কোনো আইন বা বিধিতে উপদেষ্টার উপদেশ বা পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশের উপজেলা পরিষদের ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক। ধারা ২৫ (২) পরিষদের সব সরকারি যোগাযোগ উপদেষ্টাকে জানিয়ে করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
প্রজাতন্ত্রের সংবিধান আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের কাজের পৃথক্করণকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। এখানে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান’গুলো সংবিধানের শাসন বিভাগ অংশের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান হয়েও আইন বিভাগের সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপমুক্ত নয়। উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হওয়ার দ্বিতীয় রাজনৈতিক কারণটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোনয়ন বাণিজ্য এবং বিতর্কিত নির্বাচন। বিনা ভোটের নির্বাচনে ভোট বৈতরণি পার হওয়া বেশির ভাগ নেতারা জনসম্পৃক্ত নন।
অকার্যকারিতার দ্বিতীয় উপাদান ত্রুটিযুক্ত আইন ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা। প্রথমে আইন প্রসঙ্গে বলা যায়, ধারা ১৩, ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩৩–এর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। ১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইন ২০০৯ সালের ৩০ জুন সংশোধিত আকারে পুনরায় জারি করা হয়।
১. আইনের ১৩ ধারার বিধানাবলির অপব্যবহার করে অনেক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিকভাবে হেয় বা হেনস্তার অনেক নজির ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার ব্যক্তিরা আদালতের আদেশে স্বপদে পুনর্বহাল হয়েছেন। তাই এ ধারাটি পুনর্বিবেচনার বা সংশোধনের যোগ্য।
২. ধারা ২৫ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে।
৩. ধারা ২৬ পরিষদের গণতান্ত্রিক চরিত্র বিকাশ এবং একটি সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনায় প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আইন ‘পরিষদ’কে সব নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করেছে, ‘চেয়ারম্যান’কে নয়। চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ পরিষদের পক্ষে পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে সে ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চেয়ারম্যানরা পরিষদকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়ালখুশি মতো নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিষদে আলোচনা হয় না বা পরিষদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করা হয়। উপজেলা পরিষদের গাড়ির ব্যবহারে চেয়ারম্যানের একাধিপত্য, ভাইস চেয়ারম্যানদের কার্যহীন করে রাখা, নিয়মিত অফিস না করা, আইনবহির্ভূত সরকারি যানবাহন ব্যবহার, অফিসে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানোর গুরুতর অভিযোগ আছে।
৪. ধারা ২৪ (২) অনুসারে পরিষদকে হস্তান্তরিত দপ্তরের কর্মকর্তাদের বার্ষিক কার্যক্রম প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল পারফরমেন্স রিপোর্ট) লেখার দায়িত্ব দেওয়া আছে। পরিষদে আলোচনা করে তা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানদের লেখার কথা। গত ১০ বছরে কোনো পরিষদ এ কাজটি করেনি। নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের এ প্রতিবেদনের আওতায় না আনা পরিষদ ও চেয়ারম্যানদের ব্যর্থতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যান—সবাই পৃথক ও যৌথভাবে এ জন্য দায়ী। কারণ, এটি একটি ইচ্ছাধীন অবহেলা।
৫. ধারা ২৯ অনুসারে উপজেলা পরিষদের ১৮টি স্থায়ী কমিটি গঠিত হওয়ার কথা। ইউনিয়ন পরিষদসহ দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির বিধান থাকলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে উপজেলা পরিষদের আইন সংশোধন করে ‘স্থায়ী’ শব্দটি কেটে দিয়ে শুধু ‘কমিটি’ করে দেওয়া হয়। যার ফলে এ কমিটি তার গুরুত্ব হারিয়েছে। এ ‘কমিটি’র সভা করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোনো সহযোগিতা করে না। ফলে বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগ এবং বিভাগীয় কার্যকলাপের কোনো জবাবদিহি নেই।
৬.১৯৯৮ সালের মূল আইন, যা ২০০৯ সালে পুনঃকার্যকর করা হয়, তাতে ধারা ৩৩–এ বলা হয়, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের সচিব হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন।’ অত্যন্ত পরিষ্কার ও বোধগম্য বিধান। ২০১১ সালে একটি সংশোধনী এনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘সচিবে’–এর দায়িত্ব থেকে অস্বচ্ছভাবে সরিয়ে আনা হয়। উপরন্তু ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে নতুন পদে সৃষ্টি করা হয় এবং দায়িত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তখন থেকে আর সচিব নন। সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একজন সচিব থাকেন। উপজেলা পরিষদে কোনো সচিব নেই।
‘সাচিবিক দায়িত্ব’ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পালন করার কথা। কিন্তু উপজেলা পরিষদের সাচিবিক কাজের যে ব্যাখ্যা-বর্ণনা ‘উপজেলা পরিষদের (কার্যক্রম বাস্তুবায়ন) বিধিমালা-২০১০’ এ দেওয়া আছে কোনো উপজেলা পরিষদ বাংলাদেশে একাজগুলো বিধিমোতাবেক করে না। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বটা নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর বর্তায়। যেমন, সভার ‘কার্যপত্র’ লেখা, সভার সিদ্ধান্তের ফলোআপ ও বাস্তবায়ন মনিটরিং, মাসিক সাধারণ সভা ও রেগুলেটরি বিভাগগুলোর ‘ত্রৈমাসিক সমন্বয় সভা’র জন্য প্রতিটি বিভাগের প্রতিবেদন গ্রহণ ও অন্যান্য যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন, কমিটি (স্থায়ী কমিটি) এর সভা অনুষ্ঠানে সহায়তা ও কমিটির সভার সুপারিশগুলো নিয়মিত মাসিক সাধারণ সভায় উপস্থাপন ইত্যাদি কাজগুলো যে হয় না তা যে কোনো উপজেলা পরিষদের মাসিক সভার কার্যবিবরণী দেখলেই, তা বোঝা যায়।
এ কার্যবিবরণী ডেপুটি কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার, ডিএলজি ও মন্ত্রণালয়ের উপজেলা সেল নিয়মিত পান। তাঁরা কেউ কি কোনো দিন এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেছেন? উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যে কর্মতালিকা, তার মধ্যে ১৮টি কাজ উপজেলা পরিষদের সঙ্গে করার কথা। ‘বার্ষিক কার্যক্রম প্রতিবেদন’ ও ‘বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন’–এ তার প্রতিফলন থাকার কথা। যাঁরা এসব লেখেন, তাঁরা কি বিষয়গুলোর কখনো খোঁজ নিয়েছেন?
৫. উচ্চ আদালত সংগতকারণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতি রুলনিশি জারি করেছেন। উপজেলা পরিষদ আইনের ধারা ২৪ (৩) এ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এ বিভাগ একটি কমিটি করে সময়ে সময়ে উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত কর্মকর্তা ও দপ্তরগুলোর সমস্যা সমাধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমার জানা মতে, ২০১০–২০১৪ এ সময়ের মধ্যে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে দুটি সভা করা সম্ভব হয়। একটি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী ন্যস্ত হলেও ওই দপ্তরগুলোর তহবিল উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত হয়নি। অবিলম্বে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর তহবিল পরিষদে ন্যস্ত করা উচিত। ১৯৮৩–১৯৯১ পর্যন্ত তা–ই হতো। ২০১০ থেকে চালু হওয়া পরিষদের বেলায় তা আর হয়নি।
আদালতের যে আদেশ, নথি চেয়ারম্যানের দপ্তরে নিষ্পত্তি হতে হবে। এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ উপজেলা পরিষদে ন্যস্ত দপ্তরগুলোর অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব পরিষদে ওঠে না, কর্মকর্তা হস্তান্তরিত হলেও দপ্তরগুলোর ‘অর্থ ও কর্ম’ পরিষদের আইনকে পাশ কাটিয়ে হস্তান্তর হয়নি। পরিষদে হিসাব, অর্থ ও সাচিবিক দায়িত্ব পালনের কোনো কর্মকর্তা নেই। উপজেলা পরিষদ তিনটি খুঁটির ঘর। এমপি, চেয়ারম্যান ও ইউএনও। যে খুঁটি দুর্বল, সেদিকে এ ঘর হেলে পড়ে। সরকার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানদের ভালো বেতন-ভাতা দিচ্ছে। তাঁরা ভালোই আছেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্য উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না।
উচ্চ আদালত আমাদের শেষ ভরসার স্থল। তাই উচ্চ আদালতের আদেশ ও পর্যবেক্ষণে উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকারের সার্বিক চিত্রটা উঠে আসুক।
ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ। [email protected]