এই গ্লানি ঘুচবে কবে

আধা ঘণ্টার তাণ্ডবে সব হারিয়ে বিলাপ করছিলেন পীরগঞ্জ উপজেলার নন্দ রানী
ছবি: মঈনুল ইসলাম

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মাত্রই বৈষম্যের শিকার। তারা সংখ্যায় কম, ফলে কবজির জোর কম। তাদের আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমিত। ফলে সংখ্যাগুরু তার দিকে তেড়ে এলে একা নিজেকে রক্ষা করা কার্যত অসম্ভব। সেই কারণেই তাদের রক্ষার দায়িত্ব বর্তায় সংখ্যাগুরুর ওপর। গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ, ফরাসি লেখক আলবেয়ার কামুর কথায়, সংখ্যাগুরুর শাসন নয়, সংখ্যালঘুর রক্ষণাবেক্ষণ।

কামুরের এ কথা আজকের বাংলাদেশে নতুন গুরুত্ব লাভ করেছে। মুখে নিজেদের যতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির আদর্শ বলে দাবি করি না কেন, নিজের প্রতিবেশী সংখ্যালঘু ভাই ও বন্ধুকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করিনি, তাদের এ নিশ্চয়তা দিতে পারিনি যে বাংলাদেশে তারা সম্মান ও সমানাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে।সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে যে রক্তপাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা এ কথার প্রমাণ।

এসব ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সব সদস্যকে দায়ী করা অন্যায়। সম্ভবত ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী বা কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই এ কাজ করেছে। কিন্তু দোষটা পড়েছে আমাদের সবার ঘাড়ে। নিউইয়র্ক টাইমস এ ঘটনাকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত ‘সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। দেশ-বিদেশের অন্যান্য পত্রপত্রিকাও একই কথা বলেছে। অন্য কথায়, অপরাধের দায়ভার আমাদের সবার, তা আমরা যতই পাল্টা যুক্তি দেখাই, যতই একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে তার গুরুত্ব লঘু করার চেষ্টা করি না কেন।

দুই ধরনের ব্যর্থতার কথা বলা যায়। প্রথমত, যা ঘটেছে তা আইনের শাসনের সঙ্গে জড়িত, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে ‘আমরা জানা মাত্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি,’ এমন কথা দাবি করা হলেও তাতে ব্যর্থতার মাত্রা লাঘব হয় না। দ্বাররক্ষীর কাজ চোর ধরা। চুরির পর সে যদি বলে, ‘কই, আমার চোখে তো কোনো চোর পড়েনি, পড়লে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিতাম।’ তার সে কথা ধোপে টিকবে না। অতএব দাঙ্গার পর লেঠেল পাঠিয়ে প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না।

কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যর্থতা আমাদের সামগ্রিক অক্ষমতা। মুসলমানদের ঈদ উৎসবের মতো দুর্গাপূজা বাংলাদেশের হিন্দুদের সর্ববৃহৎ উৎসব। সারা বছর আমরা সবাই যার যার প্রধান উৎসবের অপেক্ষায় থাকি। মুসলমানদের ঈদ উৎসব নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হয়েছে। প্রবাসে দেখেছি মুসলমান গৃহস্বামী হিন্দু পরিচিতজন বা নিকট বন্ধুদের বিশেষ দাওয়াত দিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। দেশেও যে একই ঘটনা ঘটেছে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার শৈশবে এটাই নিয়ম ছিল।

এবার আমরা মুসলমানরা নির্বিঘ্নে উৎসব সারলাম, অথচ নিজের প্রতিবেশী হিন্দুদের সেই সুযোগের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হলাম। যতই ‘না না’ করি না কেন, এ জন্য সংখ্যাগুরুর প্রত্যেকের দায়ভার এসেই পড়ে।

একটা প্রবণতা চোখে পড়েছে, আর তা হল ভারতকে টেনে আনা। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করার বদলে আমরা যখন বাহানা খুঁজতে হাত বাড়াই ভারতের দিকে, তখন বিষয়টি দৃষ্টি এড়ানো বা বিষয়ান্তরের চেষ্টা বলে মনে হওয়া অন্যায় নয়। মানছি, ভারতে কী হলো তার প্রতিক্রিয়া আমার দেশে পড়বে ও পড়ে।

প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমাদের মনঃপুত না হলে আমরা তার প্রতিবাদ জানাতে পারি, তা আমরা জানিয়েও থাকি। যেমন, ভারতের ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব নিবন্ধন আইনের প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিশেষ দূতের সঙ্গে সাক্ষাতে অপারগতা প্রকাশ করে তাঁর প্রতিবাদ ও অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

একই কারণে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকারি আতিথ্য গ্রহণে অস্বীকার করেছেন। এসবই প্রতিবাদের ন্যায্য ও নিয়মসিদ্ধ উপায়, কিন্তু ভারতে মুসলমান নিগ্রহের শিকার, অতএব নিজের দেশের হিন্দু ভাই বা বন্ধুকে পিটিয়ে হাতের সুখ মেটাব, এটা কেমন কথা?

লক্ষ করেছি এ ঘটনায় একটি ধর্মীয় রং দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অবমাননার প্রতিবাদে বক্তব্য-বিবৃতি তো রয়েছেই। আরও রয়েছে মিছিল, ভাঙচুর ও সহিংসতা। এ কেবল শহরের বাইরে লোকচক্ষুর অন্তরালে নয়, ঢাকাতেও সংবাদমাধ্যমের উজ্জ্বল আলোর নিচে ঘটেছে।

নিজেদের ধার্মিক ভাবে—এমন অনেকে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি করেছে। অথচ যে অবমাননার কথা বলা হয়েছে, সেটি আসলে কার কাজ, তা নির্ধারণের আগেই এসব ধার্মিক ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি কী করে সংখ্যালঘুদের ঘাড়ে সে দোষ চাপায়? পুজা মন্ডপে মুসলমানের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রেখে কোনো হিন্দু যে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবে না, সে কথা বুঝতে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না।

হিন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টায় অনুরূপ ঘটনা আগেও ঘটেছে। সেখানেও দেখেছি অপরাধী কোনো হিন্দু নয়, বরং ঘোঁট পাকাতে চায় এমন লোকদের কুবুদ্ধিতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়ভাবে ফায়দা নিতে চায় এমন লোকের অভাব নেই। হিন্দু খেদানো গেলে তার মন্দির বা বসতবাড়ির জায়গাটুকু ভোগদখল করা যায়।

আবার, রাজনৈতিকভাবে জল ঘোলা করতে চায় এমন লোকও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সরকারের বিরোধী মহলও এ কাজে উৎসাহী হতে পারে। এসব কথা বিবেচনায় না এনে কিছু লোক দুর্বল হিন্দুদের ওপর চড়াও হলো, সে কি এ জন্য যে ‘কেষ্ট ব্যাটা’কে চোর বলে পার পাওয়া সহজ। দুর্গা প্রতিমা হিন্দুদের কাছে পবিত্র, তার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে কোন সওয়াবের কাজটি তারা করল?

মহাত্মা গান্ধী একটি কথা বলতেন। একটা দেশ বা জাতি কতটা সভ্য তা বোঝার জন্য সে দেশের বা সে জাতির নারী ও সংখালঘুর অবস্থা দেখ। তারা যদি সমানাধিকার ভোগ করে, সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে বুঝবে সে দেশ বা জাতি সভ্য হয়েছে।

গান্ধীর নির্দেশিত সভ্যতার এ মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থা গ্লাসের অর্ধেক ভরা, বাকি অর্ধেক খালির মতো। নারীর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ বহুলাংশে সফল। কিন্তু সংখ্যালঘুর সমানাধিকার অর্জনে আমরা লক্ষ্যণীয়ভাবে পিছিয়ে।

নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ যে অভাবিত উন্নতি করেছে, তা সম্ভব হয়েছে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ প্রশ্নে এসেছে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা।

পুরোনো আইন বদলিয়ে নতুন আইন হয়েছে, সে আইন প্রতিপালনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে।
সংখ্যালঘুর অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারি পর্যায়ে যে আগ্রহ নেই, এ কথা হয়ত কেউ বলবে না। কিন্তু সে আগ্রহের সঙ্গে যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, পলিটিক্যাল উইল চাই—সেটির সম্ভবত খামতি রয়েছে।

এ কথা বলার কারণ, এ কথা এখন প্রমাণিত যে গত দু-তিন দশকে যত দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই ক্ষমতাসীন মহলের নিকট সম্পর্ক রয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তারা শাস্তি পেয়েছে এ কথা বলা যাবে না। সরকারের ক্ষমতা অপরিসীম, অপরাধী নির্ধারণ ও তাদের বিচার নিশ্চিত করার বিস্তর হাতিয়ার তার হাতের নাগালে রয়েছে।

তারপরও যে প্রায় সময়ই দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয় না, তার কারণ একটাই, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।

পূজার সময় এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তেমন আশঙ্কা তো ছিলই। সে কথা মাথায় রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত, ক্ষমতাসীন দল যদি নিজেদের সদস্য ও সমর্থকদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিতেন, তাহলে এমন ঘটনা ঠেকানো কঠিন হতো না। আজকাল কৃষকের সাহায্য হবে ভেবে দলীয় স্বেচ্ছাসেবকদের ধান কাটতে পাঠানো হচ্ছে। হিন্দুদের মন্দির রক্ষায় বা কেন পাঠানো হবে না?

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে সবচেয়ে আগে সোচ্চার হওয়ার কথা দেশের ধর্মীয় নেতাদের। ইসলাম ধর্ম শুধু পরধর্ম সহিষ্ণুতার কথাই বলে না, সংখ্যালঘুর রক্ষার দায়িত্বও সংখ্যাগুরু মুসলিমের ওপর আরোপ করেছে। কিন্তু কই, আমাদের ধর্মীয় নেতাদের তো এগিয়ে আসতে দেখা গেল না।

এর বিপরীতে অন্ধকারে আলো হয়ে এসেছে নাগরিক মহলের একাংশের প্রকাশ্য প্রতিবাদ।

বিভিন্ন শহরে অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে মানববন্ধন হয়েছে। খুব উচ্চকণ্ঠে হয়তো নয়, অতি সুশীল এসব সমাবেশ, যেখানে পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়েনি। তারপরও আশ্বস্ত হয়েছি আমাদের প্রতিবাদের শক্তি একদম নিঃশেষিত হয়নি তা দেখে। কিন্তু প্রতিবাদের এ প্রদীপটি এমন নিভু নিভু যে ভয় হয় খুব জোরে একটা হাওয়া এলে তা হয়তো একদমই নিবে যাবে।

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক