এই মৃত্যু কি ঠেকানো যেত না?

বাস থেকে নেমে পানি মগ্ন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে যান ছালেহ আহমদ নামে এক ব্যবসায়ী। একদিনেও তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ছবি: সংগৃহীত

ভাদ্রের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিলম্বিত বর্ষায় ফের ডুবেছে চট্টগ্রাম শহর। বৃষ্টিতে, জোয়ারের পানিতে পাহাড়ি নগরটি ডুবে যাওয়ার সমস্যা শুনতে শুনতে এখন চট্টগ্রামতো বটেই, সারা দেশের মানুষও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাই চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট ডোবার খবরে আজকাল পাঠকের মনে সেরকম কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করে না। কিন্তু এবারের পানিজটে একটি পরিবারের ভাগ্যও চিরদিনের মতো ডুবে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন সুস্থ সবল মানুষ থই থই পানির অতলে তলিয়ে গেল। ২৫ আগস্ট বুধবার সকালের ঝুম বৃষ্টিতে কী ঘটেছিল, মানুষ পরের দিন শরতের ঝকঝকে সকালে ভুলে গেছে। কিন্তু ছালেহ আহমদের পরিবার, আত্মীয়স্বজন কি ভুলতে পারবে এই বৃষ্টিস্নাত দিনটির কথা? সেই বৃষ্টি সারা জীবন তাদের চোখের জল হয়ে ঝরতেই থাকবে।

বাস থেকে নেমে পানি মগ্ন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলেন ছালেহ আহমদ। সেসময় ঘোলা পানির স্রোতের ভেতর রাস্তা, ফুটপাথ, নালা সব একাকার। পাশের নালাটি খেয়াল করেননি তিনি। পলক ফেলার সময় পাননি, চলে গেলেন। সেই যে গেলেন তার আর হদিস পাওয়া গেল না। বুধবার রাত ১১ টা অবধি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৮ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে খুঁজে পায়নি তাঁকে। পটিয়া থানার মনসার বাসিন্দা ছালেহ আহমদের পরিবার থাকে গ্রামে, আর নিজের ব্যবসার কাজে তিনি শহরেই থাকতেন। মঙ্গলবার তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন। বউ ছেলে মেয়ের সঙ্গে সেটাই যে তাঁর শেষ দেখা হবে কে জানত? জলের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে ছালেহ আহমদের খোঁজ পাওয়া যায়নি, আর সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিবারের ভবিষ্যৎটাও যেন অন্ধকারে হারিয়ে গেল। মনসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাঁর কন্যা জান্নাতুল মাওয়া, আর পটিয়ার একটি কলেজের শিক্ষার্থী তাঁর পুত্র সাদেক উল্লাহর শিক্ষাজীবন এখন একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।

বুধবার মুরাদপুরের এই ঘটনায়, ছালেহ আহমদের সলিলসমাধি হওয়ার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তার মৃত্যদৃশ্যটি সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ছিল আর তা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। তাতে মানুষের মনে ক্ষোভ ও আক্ষেপ বেড়েছে। অনেকেই বলেছেন এ রকম মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই মৃত্যুটা একেবারেই গাফিলতি থেকে হয়েছে বলে সবাই মন্তব্য করছেন। মুরাদপুর পুলিশ বক্সের সামনে যেখানে বুধবার ছালেহ আহমদ পড়ে গেলেন, ঠিক সেই জায়গায় কদিন আগে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পরিদর্শনের সময় কর্মকর্তারা জায়গাটিকে খুবই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেন। কারণ রাস্তার পাশে নালাটির কোনো ঢাকনা নেই। বৃষ্টির পানিতে সেখানে নালা, রাস্তা সব একাকার হয়ে যায়। পরিদর্শক দল সেই জায়গায় নালাটি ঘিরে দেওয়ার জন্য রেলিং নির্মাণের পরামর্শ দেন সেখানে ‍উপস্থিত সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তাকে। কিন্তু গত দুই মাসে সেই রেলিং নির্মাণের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সিটি করপোরেশন। এই ঘটনা জানার পর যে কোনো মানুষের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে এই মৃত্যু কী ঠেকানো যেত?

চট্টগ্রামের মানুষ কোনো জবাব পায় না বছরের পর বছর খালের সংস্কার চলে, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চলে, তারপরও কেন পানির তলায় চলে যায় একটা নগর।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতার শিকার ছালেহ আহমদ প্রথম নন। গত ৩০ জুন মেয়র গলিতে দুজন প্রাণ হারালেন। বছর দু-এক আগে মোহাম্মদ আলী সড়কে একজন, চার বছর আগে আগ্রাবাদে মারা গিয়েছিলেন আরও দুজন। জলাবদ্ধতায় মানুষের মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান হয়তো সংবাদ হিসেবে খুব একটা বড় নয় কিন্তু মানুষের মৃত্যু শুধু পরিসংখ্যান নয়। সেটাতো একটি পরিবারের বিপর্যয়। একটি পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া। এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান না হলে এই সব ছোট ছোট পরিবারের ট্র্যাজেডি বাড়তেই থাকবে। যে বৃষ্টি কল্যাণের প্রতীক, স্বস্তির প্রতীক, যে বৃষ্টি আবাদের , ধুলোমলিন দূর করে আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসার কথা যে বৃষ্টি, সেই বৃষ্টি বন্দর নগরীর জন্য অভিশাপ হয়ে কেন আসে? কেন শুধু বৃষ্টির কারণেই পাহাড় ধসে ২০০৭ সালের পর থেকে চার শর বেশি মানুষ প্রাণ হারায়? এসব প্রশ্নের জবাব চট্টগ্রামের মানুষ পায় না।

চট্টগ্রামের মানুষ কোনো জবাব পায় না বছরের পর বছর খালের সংস্কার চলে, জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চলে, তারপরও কেন পানির তলায় চলে যায় একটা নগর। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমানে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে চট্টগ্রামে। ১০ হাজার ৯২১ কোটি ২২ লাখ টাকার এই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বাড়ছেই। প্রকল্পে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, আগে জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব বেশি ছিল এখন তা কমে গেছে। তাঁরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রায় বলে থাকেন, কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ার আগে সুফল পাওয়া যাবে না, আগামী বছরে আরও সুফল পাওয়া যাবে। তবে কথা হচ্ছে সেই সুফল পাওয়ার আগে জলাবদ্ধতার পরিধি কিন্তু দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে এবং তা ঘন ঘন হচ্ছে।

এর আগে জুন মাসের ৬ তারিখ ও ৩০ তারিখ, তারপর ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম ডুবল। সর্বশেষ গত বুধবারের বৃষ্টিতে আগের চাইতে বেশি এলাকা জলমগ্ন হয়েছে। এর জন্য অনেকটা দায়ী চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষই। কেননা জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছে এই কর্তৃপক্ষ। তারা কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আবার পাশাপাশি তাদের গাফিলতির কারণে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় প্রতিটি সড়কে, অলিতে গলিতে গড়ে উঠছে শত শত দালান। এগুলোর অধিকাংশই দালান নির্মাণবিধি মানছে না। দেয়ালে দেয়াল লেগে গড়ে উঠছে সব দালান। বেশির ভাগ ভবন এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ছে না। বহু ভবন তাদের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখে না। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ ব্যাপারে থাকেন নির্বিকার। কেউ লিখিত অভিযোগ করলেও তার প্রতিকার মেলে না।

এ ছাড়া অপরিকল্পিত সড়ক ও ফুটপাথ উন্নয়নও নতুন নতুন জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা বাড়ার আরেকটি কারণ। চট্টগ্রাম নগরের উঁচু জায়গাগুলোর অন্যতম একটি হলো নন্দন কানন। ডিসি পাহাড়ের পাদদেশের এই এলাকাটি বেশ উঁচুতে। একসময় ধারণা ছিল, সারা চট্টগ্রাম ডুবলেও নন্দনকানন ডুববে না। নন্দনকাননের বৌদ্ধ মন্দির সড়কের ফুটপাথটি সংস্কার করে উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি সরে গিয়ে নালায় পড়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পানি অপসারণের পথ রাখা হয়েছে খুব সংকীর্ণ। ফলে বৃষ্টি হলেই নন্দনকাননের বৌদ্ধ মন্দির সড়কে পানি জমে। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পরও জমে থাকে। তাতে যানচলাচল বিঘ্নিত হয়, মশার প্রজনন বাড়ে।

এইভাবে পুরো চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার পরিধি বাড়ছে। এর জন্য মানুষের অসচেতনতা দায়ী বটেই, কিন্তু সবচেয়ে বেশি দায়ী চউক আর সিটি করপোরেশন। শুধু কোটি কোটি টাকার প্রকল্প চালানোর সন্তুষ্টিতে থেকে জনগণকে আশ্বাসের বাণী শোনালে চলবে না, নগরটাকে বসবাসযোগ্য রাখার জন্য এই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞান, নীতি নৈতিকতাবোধও চাঙা করতে হবে। নইলে নালায় পর্যবসিত হওয়া, দখল হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের খালগুলোতে শুধু আবর্জনা জমবে না। দিনে দিনে মানুষের ভোগান্তির কষ্ট আর ছালেহ আহমদের পরিবারের সদস্যের মতো অনেক মানুষের অশ্রুও জমা হবে।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।