একজন বাবা আসলে কেমন?
আচ্ছা, কেমন হওয়া উচিত একজন বাবার? প্রশ্নটা করলাম বটে, কিন্তু এ উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেই হোঁচট খাচ্ছি। কারণ, আমি নিজেও একজন বাবা। আর বাবা মানেই এমন এক শক্ত খুঁটি, যার ওপর পাহাড়সম দায়িত্ব আর সাগরসম মমতায় গড়ে ওঠে সন্তানের পরম নির্ভরতার ছাউনি।
কিন্তু বাবা ও সন্তানের চিরন্তন এই অমৃতবন্ধনে জল্লাদের খড়্গ চালানোর মতো ঘটনা যখন ঘটে, তখন প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয় যে একজন বাবা আসলে কেমন? কী তাঁর ভূমিকা?
প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ১৭ মাসের শিশুকন্যাকে ছুরিকাঘাত করার অভিযোগ উঠেছে এক বাবার বিরুদ্ধে। দীন ইসলাম নামের এই বাবার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। শিশুটি বাবার গায়ের গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই চলে গেছে চিরঘুমের দেশে। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের তথ্যের বরাত দিয়ে সিআইডির কর্মকর্তা বলছেন, মেয়েকে আসলে হত্যা করার জন্য ছুরিকাঘাত করেননি। কিন্তু ছুরি তো চালিয়েছেন! ভাবা যায়?
গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে এমন একটি ঘটনা ঘটে। পৌর এলাকার আজাইপুরে মাহিয়া নামের ২২ মাস বয়সী এক শিশুকন্যাকে হত্যার অভিযোগ ওঠে মাহবুব হোসেন নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। শিশুর ফুফুর ভাষ্য, মাহিয়ার কান্নাকাটি সইতে না পেরে তার মাথায় ইট মারেন মাহবুব। এতে মারা যায় শিশুটি।
শিশুর প্রতি সবারই কমবেশি কোমল অনুভূতি থাকে। মানুষ তো মানুষ, কুকুর-বিড়ালের ছানা দেখলেও তো মায়া হয়। আর এরা কেমন মানুষ, কেমন পিতা—নিজেই আত্মজার প্রাণসংহারী!
প্রাণিকুলে মানুষের চেয়ে অবর প্রজাতির মধ্যে নির্মমতা আছে ঠিকই, কিন্তু বাবা হিসেবে পিতৃত্বের জ্বলন্ত প্রতিভূর নমুনাও কম নেই। শিয়ালকে যতই ধূর্ত প্রাণী হিসেবে ভর্ৎসনা করি না কেন, বাবা হিসেবে অতুলনীয়। আফ্রিকায় কালোপিঠ শিয়াল এর উজ্জ্বল উদাহরণ। মা শিয়াল যাতে শাবকগুলোকে প্রয়োজনীয় দুধ দিতে পারে, এ জন্য প্রয়োজনীয় খাবার এনে দেয়। শাবক একটু বড় হলে মা শিয়াল যখন ডেরা ছেড়ে বাইরে যায়, বাবা তখন ছানাগুলোর দেখভাল করে।
সি হর্স বা সাগরঘোড়াও বাবা হিসেবে বেশ দায়িত্বশীল। মা সি হর্স বাবা সি হর্সের পেটে থাকা বিশেষ থলেতে ডিম পাড়ে। সেখানেই ডিম থেকে ছানা ফোটে। অ্যান্টার্কটিকায় রাজ-পেঙ্গুইনদের মধ্যে স্ত্রী পেঙ্গুইন একটি মাত্র ডিম পাড়ে। বাবা পেঙ্গুইন টানা চার মাস পায়ের ওপর ডিমটি রেখে তা দেয়। সে এক কঠিন পরীক্ষা! কারণ, ডিমটি পা থেকে বিচ্যুত হলেই বরফে পড়ে জমে যাবে।
এমন উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। আর ওদের চেয়ে অনেক উন্নত প্রাণী হয়েও আমরা করছি সীমাহীন নির্মমতা, যা কল্পকাহিনির রাক্ষস-খোক্ষসের নারকীয় কাণ্ডকেও হার মানায়। অথচ ‘বাবা’ নামে দুই অক্ষরের শব্দের মাহাত্ম্য কম নয়। মা যদি হন সন্তানের পরম নিরাপদ আশ্রয়, বাবা অপরিমেয় নির্ভরতার আধার। একটি সন্তান বাবার কোলে-কাঁখে, বুকে-পিঠে হেসেখেলে আপন মহিমা খুঁজে পায়। সন্তানের সাফল্যে বাবা খুশি, ব্যর্থতায় ব্যথিত।
সাত বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি বলে এই শূন্যতা খুব কঠিনভাবে মনে পড়ে। ছোটবেলায় কোথাও গেলে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটি করা হতো, তা হলো—‘তোমার বাবা কী করেন?’ বাবা কী জিনিস, তখন মর্মে মর্মে টের পেতাম। এরপর যে প্রশ্নটি করা হতো, তা হলো—‘কী করে তোমার বাবার মৃত্যু হলো?’ প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু এর উত্তর দিতে গিয়ে ঘাড়ের ওপর হিমালয়ের চাপ অনুভব করতাম। সমবয়সীরা দুরন্তপনায় মেতে উঠত, কিন্তু আমি বা আমরা ভাইবোন তেমন কিছু করতে গেলে বড়রা সাবধান করত, ‘তোর কিছু হলে কে দেখবে?’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হতো—বাবার সেই নির্ভরতার স্থানটি। এসএসসিতে প্রথম যখন পাবলিক পরীক্ষা দিলাম, বন্ধুদের সবার বাবা এসে নিজ নিজ সন্তানের পরীক্ষার খোঁজ নিচ্ছেন, সেখানে বাবাহীন আমি কতটা অসহায়, খুব ভালো করেই টের পেয়েছিলাম। এইটুকু জীবনে বুঝেছি, একজন সন্তানের কাছে বাবার ছায়া আকাশছোঁয়া, তাঁর আবেদন থাকে জীবনব্যাপী। তেমনি প্রত্যেক বাবাই এমন এক মহিরুহ, যারা মায়াময় ছায়াঘেরা ডালপালার বিস্তৃতির কোনো শেষ নেই।
ছোটাবেলায় ইতিহাসে পড়েছি মুঘল সম্রাট বাবর ও তাঁর ছেলে অপর সম্রাট হুমায়ুনের কাহিনি। হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। মরো মরো অবস্থা। বাবা বাবর প্রার্থনায় বসে গেলন, তাঁর ছেলের অসুস্থতা তাঁর মধ্যে ফিরে আসুক, বিনিময়ে তাঁর সুস্থতা ছেলের মধ্যে যাক। বাবার অন্তরাত্মার এই কামনা সত্যি হলো। হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে চিরবিদায় নিলেন। পিতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ এটা।
জ্বলন্ত উদাহরণ বাস্তবেই আছে। নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার শফিকুল ইসলাম এমন এক বাবা, নিজের জীবন দিয়ে যিনি সন্তানকে রক্ষা করেছেন। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বগুড়া শহরতলির শাকপালা এলাকায় ওই ছিনতাই ও খুনের ঘটনা ঘটে। সেনানিবাসে সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছেলে আশরাফুল ইসলাম প্রশিক্ষণ শেষে মঙ্গলবার রাতে বাসে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা হন। রাত তিনটার দিকে জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস-সংলগ্ন শাকপালা বাসস্ট্যান্ডে ছেলেকে এগিয়ে নিতে আসেন শফিকুল। বাস থেকে নামার পর ছেলেকে নিয়ে বাসার দিকে আসার পথে মেলেনিয়াম স্কলাস্টিকা স্কুল-সংলগ্ন স্থানে ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে বাবা-ছেলের পথরোধ করে। ছেলে আশরাফুলের কাছ থেকে মুঠোফোন, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার সময় শফিকুল ইসলাম বাধা দেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা তাঁর কোমর ও ঊরুতে ছুরিকাঘাত করে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শফিকুল ইসলাম মারা যান। ঘটনা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। কিন্তু এটাই একজন বাবার শাশ্বত রূপ।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
[email protected]