একটি অন্যায্য আইনের অবসান হোক

এই আইন হওয়ার আগে শহরের বাইরে বাসাবাড়ির কোনো অংশ বা যেকোনো সম্পত্তির অংশ যদি কোনো অংশীদার সহ-অংশীদার ছাড়া বাইরের কোনো লোকের কাছে বিক্রি করতেন, তাহলে সহ-অংশীদার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদালতে ওই সম্পত্তির দাম ও ক্ষতিপূরণের টাকা দাখিল করলে তিনিই সম্পত্তির মালিকানা পেতেন।

এই আইন হচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’, ইংরেজিতে ‘এস্টেট রিকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট’। আইনটির ৯৬ নম্বর ধারা কোনো সম্পত্তির সহ-অংশীদারদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছিল। বিশেষ করে বসতবাড়ির অংশ যদি বাইরের কোনো লোক কিনে নেন এবং তিনি যদি মারমুখী বা প্রতাপশালী হন, তাহলে বসতবাড়ির অন্য অংশীদারদের পক্ষে সেখানে টিকে থাকা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

এসব ক্ষেত্রে যিনি বিক্রি করেন, তিনি সব সময়ই বেশি দাম পেতে চান। সহ-অংশীদারদের কী হলো না হলো, সেই চিন্তা তাঁর কাছে প্রাধান্য পায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পত্তি কেনাবেচা হয় গোপনে। এ ক্ষেত্রে বসতবাড়ির অংশ বাইরের লোক কিনে নিলে সহ-অংশীদারেরা যদি সেই সম্পত্তি পাওয়ার জন্য আবেদন করতে না পারেন, তাহলে তাঁরা দুর্ভোগে পড়বেনই।

আইনটি যে সরকার করেছে, তারা কিন্তু জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে সহ-অংশীদারদের কপাল পোড়ার ব্যবস্থাই করে গেছে। এই আইনে পরিষ্কার বিধান রাখা হয়েছে যে বসতবাড়ির অংশ অন্যত্র বিক্রি হলে সে সম্পর্কে সহ-অংশীদারেরা টাকা দাখিল করার কোনো সুযোগ পাবেন না। এখানে লক্ষ করার মতো ব্যাপার এই যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যাঁরা সম্পত্তি বিক্রি করে দেশান্তরি হন, তাঁরা এখানে অবস্থানকারী তাঁদের সহ-অংশীদারদের প্রতি খুব একটা ভালো মনোভাব নিয়ে যান না। বরং সহ-অংশীদারদের প্রতি তাঁদের একটা বিদ্বেষের মতোই থাকে, যার ফলে তাঁরা বিপরীত চিন্তার লোকের কাছে বেশি দামে সম্পত্তি বিক্রি করে যান।

এসব ক্ষেত্রে যিনি সম্পত্তি কেনেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সম্পত্তির দখল নিয়ে নেন। ফলে সহ-অংশীদারেরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সাধারণত দেখা যায়, কিছুদিনের মধ্যে তাঁরাও নিজ নিজ অংশ বিক্রি করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এই রকম একটা দুঃসহ অবস্থায় গত ১০ বছরে অসংখ্য সংখ্যালঘু দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু যে সংখ্যালঘুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিষয়টি অবশ্য তেমন নয়। সংখ্যাগুরুদের মধ্যে যাঁরা দুর্বল, তাঁরাও এই আইনের সমান ভুক্তভোগী। একই সমস্যায় তাঁরাও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। আর যাঁরা সমাজে প্রভাবশালী, তাঁরা এই আইনের পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছেন।

এই আইনের বিষয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছে এবং উঠছে। বর্তমান সরকারের কাছেও আইনটি সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইনটি সংশোধনেরও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে দেশত্যাগী অসহায় মানুষের সংখ্যা। প্রশ্ন হচ্ছে, কত দিন আর এই সমস্যা চলতে থাকবে? আর কত দিনই বা মানুষ এই ভোগান্তির শিকার হবে?

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর তখনকার সরকার শত্রু সম্পত্তি আইন প্রবর্তন করেছিল। সেই আইনের ফলে লাখ লাখ পরিবার নিঃস্ব হয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ সেই কালো আইনটি বাতিল করেছিল। তারপরও সেই আইনের রেশ ধরে মানুষের হয়রানি চলতেই থাকে। অবশেষে বর্তমান সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন চালু করলে সেই হয়রানির আপাত-সমাধান হয়।

২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের আলোচ্য আইনটিও একটি হয়রানিমূলক আইন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই আইন বাতিল করা উচিত।

তপন চক্রবর্তী: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী