একসঙ্গে সুস্থ হই, শিখি আর আলো ছড়াই

ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাও

যুদ্ধ, নিপীড়ন, সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে আজ সারা বিশ্বে ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। বাস্তুচ্যুত মানুষের এ রেকর্ড সংখ্যা পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুতির প্রধান উৎসের পাঁচটি দেশের একটি মিয়ানমার, যেখান থেকে ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

উদার মানবিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশ চার বছর ধরে এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কক্সবাজারে আশ্রয় দিচ্ছে। এই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়; কিন্তু তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ার একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। তার আগপর্যন্ত এখানে আমরা তাদের সুরক্ষা, সহায়তা ও নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেক শরণার্থীর রয়েছে ব্যক্তিগত দুঃখ–কষ্ট ও যন্ত্রণার ইতিহাস। বিশ্ব শরণার্থী দিবসের এই দিনে আমরা স্মরণ করি তাদের দৃঢ় প্রত্যয় ও টিকে থাকার মনোভাবকেও। তারা নিয়মিত সংগ্রাম করে যাচ্ছে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে। তারা আশাবাদী, একদিন তারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবে।

এই বছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘টুগেদার উই হিল, লার্ন অ্যান্ড শাইন’—সুস্থ হই একসঙ্গে, শিখি, আর আলো ছড়াই। এর মাধ্যমে শরণার্থীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলাধুলা ও শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ আমাদের গত এক বছরে দেখিয়েছে ভাইরাস প্রতিরোধে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্থানীয় জনগণের অভূতপূর্ব স্পৃহা ও প্রত্যয়। মহামারির শুরু থেকেই বাংলাদেশি ও শরণার্থী স্বেচ্ছাসেবকেরা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ১ হাজার ৫০০ কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীসহ হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক দিনরাত কাজ করছে করোনা সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা বাঁচাচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে।

মহামারিতে ইউএনএইচসিআরের মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের মাধ্যমে শরণার্থীরা পাস্পরিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও মনঃসামাজিক সহায়তা দিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাইকে মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ দিচ্ছে। ভিডিও এবং অনলাইন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোর দায়িত্ব পালন করছে। তরুণ রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ ওমার’স ফিল্ম স্কুল নিজেদের ভাষায় তৈরি করছে করোনা থেকে বাঁচার ও অন্যান্য ভিডিও। ঝুঁকি উপেক্ষা করে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন সবাইকে রক্ষা করার জন্য। এ রকম জনসংযোগ ও সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নেতৃত্ব, আত্মবিশ্বাস ও প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার শক্তিও।

চলমান মহামারিতে পুরো বিশ্বে স্কুল এবং বিভিন্ন শিক্ষাদানকেন্দ্রের (লার্নিং সেন্টার) কার্যক্রম তীব্রভাবে ব্যাহত হয়েছে। প্রায় ৮৫ শতাংশ শরণার্থী শিশু বাস করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। শরণার্থীদের জন্য স্কুলে যাওয়াটা এমনিতেই চ্যালেঞ্জিং, লকডাউনের কারণে সেটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেও শরণার্থী লার্নিং অ্যাসিস্ট্যান্টরা ঘরে ঘরে যাচ্ছে, শিশুদের পাঠদান করছে। স্কুল ও লার্নিং সেন্টারগুলো না খোলা পর্যন্ত ‘কেয়ারগিভার লেড এডুকেশন’-এর মাধ্যমে শিশুদের ঘরে বসে শেখানোর কাজ চলবে। পাশাপাশি চলছে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তুতি, মহামারি পরিস্থিতি উন্নত হলেই সেটি চালু করা যায়। রোহিঙ্গা শিশুদের প্রজন্মটি শিক্ষার আলো থেকে যাতে বঞ্চিত না হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।

মানসিক আঘাত বা ট্রমা কাটিয়ে ওঠার জন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা আছে। শরণার্থীশিবিরে খোলা জায়গা খুবই সীমিত, এরপরও অনেকে বিকেলে ফুটবল, ভলিবল ও মিয়ানমারের ঐতিহ্যবাহী খেলা চিনলোন খেলে। তরুণ শরণার্থীরা রিফিউজি অলিম্পিক টিমকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে এবং এই টিমের অনবদ্য অর্জন আমাদের মুগ্ধ করে। অলিম্পিক টিমটির অ্যাথলেটরা নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রতিনিধি করছে তারা।

সম্প্রতি আমরা দেখেছি কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে জন্মানো রোহিঙ্গা তরুণ নুর কবিরকে অস্ট্রেলিয়ায় বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন হতে। শরণার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা তিনি। একজন পুষ্টিবিদ হয়ে তাঁর জ্ঞান কক্সবাজারের শরণার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি। অনেক তরুণ শরণার্থী শিল্পের মাধ্যমে তাদের শক্তি প্রকাশ করছে। গত ২২ মার্চ রোহিঙ্গা শিবিরে বড় একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রায় ৪০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১১ জন শরণার্থী মারা যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শরণার্থী তরুণদের তৈরি একটি শৈল্পিক ম্যুরাল। শরণার্থীদের জীবনের গল্প এ রকমই, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং কঠিনতম পরিবেশেও তারা আলো ছড়ায়।

প্রতিবছর বর্ষাকালের ভারী বৃষ্টি এবং সাইক্লোনও মোকাবিলা করে থাকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় বাংলাদেশিরা। তখনো শরণার্থী এবং বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকেরা মানুষের জীবন বাঁচায় ও জনসচেতনতা গড়ে তোলে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে এই স্বেচ্ছাসেবকেরা ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়।

রোহিঙ্গাদের এই গল্পগুলো সারা বিশ্বের শরণার্থীদের অদম্য প্রত্যয়ের সামান্য কিছু উদাহরণ মাত্র। সব ঝড়–ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তারা এগিয়ে চলে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমরা সম্মান জানাই তাদের দৃঢ় প্রত্যয়কে, আর আমরা কাজ করে যাব তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। এর সঙ্গে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই আত্মত্যাগী মানবিক বাংলাদেশি কর্মীদের ও পরিবার ছেড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সহকর্মীদের প্রতি, যারা স্বার্থহীন ও অক্লান্তভাবে শরণার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের চতুর্থ বছরে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মিয়ানমারে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সেখানে তাদের অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং তাদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সারা বিশ্বের শরণার্থীদের পাশেই আমাদের দাঁড়াতে হবে এবং তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে, যেন একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা বজায় থাকে। এভাবেই তাদের আমরা সুযোগ দিতে পারি সুস্থ হতে, শিখতে ও আলো ছড়াতে।

ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিনিধি