একুশে আগস্টের দায় বিএনপি এড়াবে কীভাবে

Sarfuddin Ahmed

গত শতকের নব্বই দশক থেকে বহুবার বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে হামলার মধ্য দিয়ে যে জঙ্গিবাদী নৃশংসতার শুরু, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে তার ‘এক পর্ব’ শেষ হয়েছে বলা যায়। এরপর জঙ্গিরা বড় ধরনের কোনো হামলা চালানোর সাহস না পেলেও তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়েছে বলা যাবে না। সুযোগ পেলেই তারা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।

১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে জঙ্গিরা অনেক বোমা হামলা করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছাড়া আর কোনোটির সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নাম আসেনি। একুশে আগস্টের হামলায় কেন বিএনপির নাম এসেছে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা দৃষ্টি দিই ওই হামলার চরিত্রটি কী ছিল।

বাংলাদেশে এর আগে যত জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আঘাত করা। সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী বা পুরোহিত-যাজককে হত্যা করে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা তাঁদের শত্রু মনে করে। কিন্তু ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং অনিবার্যভাবে মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে গত শতকের নব্বই দশকে। আফগানিস্তানফেরত কতিপয় বাংলাদেশি তরুণ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি বি) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন মুফতি আবদুল হান্নান। বাংলাদেশে যত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগেরই হোতা ছিলেন তিনি। এরপর শায়খ আবদুর রহমান ও ছিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএমবি।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর অপরাধীরা শাস্তিও পাবেন আশা করা যায়। কিন্তু এ হামলার সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততার বিষয়টি মীমাংসা হবে কি?

২০০৪ সালে যখন এই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে, তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল, এ জন্য তাদের কেউ দায়ী করছে না। তাদের আমলে আরও অনেক জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেসব ঘটনায় বিএনপির সম্পৃক্ততার অভিযোগ কেউ করেননি। ২১ আগস্টের হামলায় কেন এ অভিযোগ এল? এ হামলার সঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যে। বিএনপি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সেসব খণ্ডন করা হয়নি। অনেক প্রশ্নের জবাবও মেলেনি।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমি সংবাদ-এ কাজ করি। দিনের কাজ শেষে যখন পুরানা পল্টনের অফিস থেকে বের হই, তখনই জানতে পারি, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে।

তখনো কেউ জানেন না, কারা এই হামলা চালিয়েছে। হেঁটে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দিকে যেতেই দেখি, রক্তে ভেজা রাজপথ আর মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। শত শত জুতা-স্যান্ডেল পড়ে আছে। সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর তখনো কেউ কেউ কাতরাচ্ছিলেন, সাহায্যের জন্য আহাজারি করছিলেন। সাধারণ মানুষ, সেখানকার দোকানদার, রিকশাচালক ও পথচারীরা আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছেন। হামলার একপর্যায়ে তাঁরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে চারদিকে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হামলাকারীদের পালানোর পথ করে দেওয়ার জন্যই সেটি করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে গ্রেনেড হামলার আলামতও সরিয়ে ফেলা হয়।


আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা যে ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, সেই ট্রাক লক্ষ্য করেই দুর্বৃত্তরা প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়ে। দলের নেতা-কর্মীরা ট্রাকের ওপরই শেখ হাসিনার চারপাশে মানববর্ম তৈরি করেছিলেন, যার ছবি পরের দিন প্রায় সব কাগজে প্রকাশিত হয়। হামলার মুখে যখন দলীয় নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনাকে গাড়িতে তুলে দেন সেখান থেকে নিরাপদে কোথাও চলে যাওয়ার জন্য, তখন সন্ত্রাসীরা সেই গাড়ি লক্ষ্য করেও কয়েক দফা গুলি ছোড়ে। জঙ্গিদের হামলা থেকে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন মারা যান। আহত হন কয়েক শ।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর ক্ষমতাসীন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটি আওয়ামী লীগের কাজ। আওয়ামী লীগ জনগণের সহানুভূতি পেতেই নাকি এ হামলা চালিয়েছিল। পরবর্তীকালে নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে হুজি বি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানই এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে শেষ করে দিতে ঘৃণ্য এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। এর আগেও মুফতি হান্নান ও তাঁর সংগঠন হুজি বি একাধিকবার শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

অথচ সেদিন ক্ষমতাসীন বিএনপি হামলার সুষ্ঠু তদন্ত না করে সরাসরি আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপায়। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, প্রশাসন, গোয়েন্দা—সবাই একই সুরে কথা বলেছে। এমনকি বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশন দাবি করে বসল, এ হামলার পেছনে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। সীমান্তের ওপারের শক্তিশালী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে পলাতক সন্ত্রাসীদের দিয়ে এ হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। নির্বাহী বিভাগের তদন্তের প্রতি মানুষের আস্থা কম বলেই বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে। আর বিচারপতি জয়নুল আবেদিন সেই বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামে যা করেছেন, তা কেবল হাস্যকর নয়, লজ্জাকরও।

এখানেই শেষ নয়; ক্ষমতাসীনেরা পুরো ঘটনা ধামাচাপা দিতে জজ মিয়া নাটক সাজালেন। তাঁকে বলা হলো, ‘যদি সে শিখিয়ে দেওয়া কথা বলে, তাহলে মাসে মাসে টাকা পাবে। আর এর অন্যথা হলে ক্রসফায়ার।’ পুলিশ প্রশাসন কয়েক বছর সেই টাকা তাঁকে দিয়েছেও।

২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সিআইডি তাঁর পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। (সূত্র: প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০০৬)

পরবর্তীকালে তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেই সময়ে সরকার কেবল অপরাধীদের বাঁচাতেই নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়নি, প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেকেই এ তৎপরতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন। যে জঙ্গিগোষ্ঠী এই নরমেধ যজ্ঞ ঘটিয়েছে, সেই যজ্ঞের অন্যতম পুরোধা মাওলানা তাজউদ্দিন ছিলেন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। উপমন্ত্রীর বাসায় জঙ্গিরা একাধিকবার বৈঠক করেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর অপরাধীদের না ধরে বিদেশে পার করে দিয়েছেন।

বিএনপির নেতারা এখন বলছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তাদের দলের ‘অমুক’ নেতাকে জড়ানো হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সবিনয়ে একটি প্রশ্ন করি, গ্রেনেড হামলার পরও তাঁরা পাক্কা দুই বছর সময় পেয়েছেন। এ সময়ে মামলার তদন্তকাজ শেষ করলেন না কেন? কেন তাঁরা জজ মিয়া কাহিনি ফাঁদলেন? তাঁরা জঙ্গিদের পাকড়াও না করে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দিলেন কেন? তাঁরা যেভাবে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছিলেন, তাতে এ ধারণা অমূলক নয় যে তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের একাংশ এর পেছনে ছিল।

জঙ্গিদের বাঁচাতে কেন বিএনপি আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছিল, কেন জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান ও মাওলানা তাজউদ্দিনকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, সে প্রশ্নের জবাব তাঁদের দিতেই হবে।

বিএনপির নেতারা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুন না কেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। এ হামলার সঙ্গে বিএনপির যেসব নেতার নাম এসেছে, আদালতের বিচারে দণ্ডিত হয়েছেন, বিএনপি নেতৃত্বের উচিত হবে তাঁদের দল থেকে বাদ দেওয়া। গ্রেনেড হামলার দণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে যে দল বেশি দূর যেতে পারবে না, সেটি দলের নেতারা প্রকাশ্যে না বললেও ব্যক্তিগত আলাপে স্বীকার করেন।

অতীত কখনো পুরোনো হয় না, সে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়—এটি বিএনপির জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য আওয়ামী লীগের জন্যও।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।
ই-মেইল: [email protected]