এক দূরগামী স্বপ্নবান: এ এস মাহমুদ

ইটিভির প্রয়াত চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ
ইটিভির প্রয়াত চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ

একুশে টেলিভিশন আমাদের কাছে, মানে কর্মীদের কাছে ছিল স্বপ্নঘর। আমরা বলতাম, ‘ম্যাড হাউস’। ভাবা যায় সে সময় অর্থাৎ ১৯৯৮-২০০০ সালে শুরু হওয়া একটি বেসরকারি টেলিভিশন মানুষের রুচি, অভ্যাস, মোটকথা জনজীবনে ছাপ ফেলেছিল! প্রভাব ফেলেছিল ভাবনার বিস্তৃত জগতে। গণমাধ্যমের পরমুখাপেক্ষিতাও কেটেছিল। সর্বস্তরের সংবাদ গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছিল আপামর জনসাধারণের কাছে। ‘তথ্যবুভুক্ষু’ মানুষ আসক্ত হয়ে উঠছিল একুশে টেলিভিশনের প্রতি।
টেলিভিশন দর্শকদের বড় অংশই প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ সংবাদের ক্ষুধা নিবারণ করত একুশে টেলিভিশন দিয়ে। কোনো একটি শক্তি দিয়ে কোনো একটি ব্যবস্থাকে রাতারাতি বদলে ফেলা যদি বিপ্লব হয়, তাহলে একুশে টেলিভিশন বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। একুশে টেলিভিশন ছিল জীবন-স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। অল্প সময়েই কাজ করেছিল শিল্প-সংস্কৃতি-জীবনবোধ ও মূল্যবোধ বদলে দেওয়ার অনুঘটক হিসেবে।
একুশের পর্দায় যাঁদের দেখা যেত, তাঁরা রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে জনপ্রিয় হয়ে যান। দর্শক তাঁদের দেখতেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সেই রাতারাতি বনে যাওয়া তারকাদের তাকিয়ে থাকতে হতো পেছনের মানুষের দিকে। সেই পেছনের মানুষের কেন্দ্রবিন্দুতে, শীর্ষবিন্দুতে যিনি ছিলেন, তিনি একুশে টেলিভিশনের সম্মানিত চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ। বেসরকারি টেলিভিশন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বটে কিন্তু সামাজিক দায়বোধ এড়িয়ে কেবলই ব্যবসা নয়, সেই নীতিতে অটল ছিলেন এ এস মাহমুদ। স্বদেশি অনুভূতির মালা গেঁথে বাংলাদেশের ভেতরটা দেখাতে চেয়েছিলেন সারা বিশ্বকে। তিনি ছিলেন এক পোড়া দেশের স্বপ্নঘর—একুশে টেলিভিশনের উৎসবীজ। এই উর্বর উৎসবীজ তৈরি করেছিলেন উপযুক্ত পরিবেশের উর্বর বীজাগার, যেখানে বপন করেছিলেন স্বপ্ন। তাঁর স্বপ্ন, বিশ্বাস ও কাজে ছিল এক সুদৃঢ় সমন্বয়।
আমরা যাঁরা নিয়মিত অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলাম, তাঁর সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখা করতে হতো। প্রগাঢ় হিতৈষীর মতো ব্যক্তিগত খোঁজখবর নেওয়া থেকে শুরু করে জানতে চাইতেন, বুঝতে চাইতেন কী করছি। কীভাবে করছি। নিচু গলার হৃদ্য আলাপচারিতা, অভিজ্ঞতাজাত পরামর্শে স্বপ্নের টান থাকত। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না কিংবা থাকত না চাপিয়ে দেওয়া। একুশে টেলিভিশনের একটি সুস্পষ্ট কর্মরেখা ছিল মানবসম্পদ উন্নয়নে। কাজ করতে করতে শেখা, প্রথমবারের ভুল থেকে নিজেকে শুধরে দ্বিতীয়বার ভুল না করা। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল দক্ষ, প্রশিক্ষিত একদল পেশাদার কর্মী বাহিনী।
‘দেশজুড়ে’ নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁ, প্রত্যন্ত গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি, চালচিত্র তুলে ধরা হতো সেই অনুষ্ঠানে। তিনি নিয়মিত অনুষ্ঠান দেখে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের সমাজচিত্রে আপ্লুত হতেন। ‘দেশজুড়ে’ নিয়ে ছিল তাঁর অনেক উচ্ছ্বাস। শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিশুদের দ্বারা নির্মিত হতো ‘মুক্ত খবর’। সেই ‘মুক্ত খবরের’ খোঁজখবর নেওয়া ছিল তাঁর প্রাত্যহিক কাজ। শুধু দেশজুড়ে, মুক্ত খবর, চারদিকে নয়, বিশেষ অনুষ্ঠান নিয়েও জানাতেন তাঁর মূল্যবান মতামত। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির তিনি ছিলেন একুশের একনিষ্ঠ দর্শক।
আমি ‘বাক্স পেটরা’ নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে সেসব দেশের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে একটি অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম। বেশ কিছুদিন ধরে প্রস্তুতি নেওয়ার পর যখন চূড়ান্তভাবে মধ্য এশিয়ায় বিভিন্ন দেশে শুটিং শুরু হবে, তিনি জানতে চাইলেন কী কী হবে? আমাদের কথা শোনার পর ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্যে সমরখন্দ, বোখারার অবদান নিয়ে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা যেন এক প্রাজ্ঞ শিক্ষকের মুগ্ধ করা ক্লাসরুমে পরিণত হয়েছিল। গণমানুষের বিশিষ্ট শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গান—আমি এক যাযাবরের কথা মনে করিয়ে দিলেন, যার কথায় আছে ‘তাসখন্দের মিনারে বসে গোর্কির কথা ভেবেছি’—সেই মিনারের কথা যেন তুলে আনি। আমি তাসখন্দে গিয়ে হন্যে হয়ে সেই মিনার খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। শুটিং শেষ করে ফিরে এসে তাঁকে যখন জানালাম তাসখন্দে সেই রকম কোনো মিনার নেই। মিনার আছে সমরখন্দ, বোখারা ও ফারগান অঞ্চলে। তিনি বললেন, একজন শিল্পী হয়তো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে একটি চিত্রকল্প ভাবতে পারেন, কিন্তু একজন গণমাধ্যমকর্মী আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছুই করতে পারেন না। একুশে টিভির আনন্দ, সংকট, বিপর্যয়ে যখনই তিনি অফিসের সবাইকে নিয়ে কথা বলতেন, তাঁর একমাত্র অবলম্বন ছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আবু সাইয়িদ মাহমুদের জন্ম ১ নভেম্বর ১৯৩৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম এবং অ্যাডভান্স মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর। পেশাদার জীবন শুরু হয় ১৯৫৭ সালে, বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল-এ যোগদানের মাধ্যমে। পেশাগত জীবনে পরিচালক, ট্রান্সকম লিমিটেড; ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লি.; চেয়ারম্যান, রিলায়েন্স ইনসু্যরেন্স লি.; ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার; চেয়ারম্যান, ফিলিপস বাংলাদেশ লিমিটেড; সর্বশেষ চেয়ারম্যান ও সিইও, একুশে টেলিভিশন লিমিটেড। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই); সদস্য, ন্যাশনাল পে কমিশন; পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, ব্র্যাক; সদস্য, আল নাহিয়ান ট্রাস্ট; পরিচালক, জনতা ব্যাংকসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে জড়িত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চের পর তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে তেল প্রদানের। তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন এবং পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান।
২০০২ সালের ২৯ আগস্ট একুশে টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর গন্তব্য ছিল সেই লন্ডন। ২০০৪ সালের আজকের এই দিনে (২২ জানুয়ারি) মৃত্যুবরণ করেন দূরগামী স্বপ্নবান আবু সাইয়িদ মাহমুদ।
পারভেজ চৌধুরী: কবি ও গণমাধ্যমকর্মী।