এক হতে গিয়ে বারবার একা হই

কারও নাম নিতে চাই না। দিনটাও মনে রাখতে চাই না। আমি মায়ান রাজা বা মুঘল সম্রাট হলে হয়তো জুলাই মাসটাই ছেঁটে ফেলতাম পঞ্জিকা থেকে।
ভাবতেই পারেন, শোকে বিহ্বল হয়ে কথাগুলো বলছি। একদম না। বাংলাদেশের তরুণ শোকে বিহ্বল হয় না। বাংলাদেশের দক্ষিণে যখন ভূমিধসে মাটি চাপা পড়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এক এক করে বাড়ছিল, দেশের প্রতিটি অনলাইন খবরের পোর্টালগুলোয় সর্বাধিক পঠিত খবর ছিল চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইংল্যান্ড এগিয়ে, না অস্ট্রেলিয়া।
বলতেই পারেন, বাংলাদেশের তরুণ বলে সবাইকে এক কাতারে ফেলা ঠিক না। ধন্যবান। আমি এটাই শুনতে চাই। বরাবরই আমরা ঢালাও বিচারে জঙ্গি তরুণ বলতে শুধু মাদ্রাসার তরুণই ধরে নিয়েছি। সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন বলতেই আমরা শহুরে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত তরুণই ধরে নিয়েছি। আর স্কুল-কলেজের বইপত্তরের বাইরে কিছুই পড়ে না বলতে আমরা ধরে নিয়েছি একেবারে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব তরুণকে।
অথচ ১ জুলাই পাল্টে দিয়েছিল সব হিসাব। যদিও তারপরও বেশ কিছু দিন লজ্জায় টিভিতে তাকাতে পারিনি, মাথা নিচু করে রেডিওর মতো করে টিভিতে শুনেছি, ‘বলেছিলাম না আমাদের মাদ্রাসার ছাত্রদের খামোখাই আপনারা খারাপ বলেছেন? এখন?’ বনাম ‘দেখুন, আসলে বিষয়টা হলো গুটি খানেক বিপথে যাওয়া তরুণকে দিয়ে সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে তো প্রশ্ন তোলা যায় না!’ ধরনের সম্মানিত মুখগুলোর বিরক্তিকর বিতর্ক।
অথচ কথা ছিল এই একটা দিনের ঘটনাতেই আমাদের সবার সম্মিলিত হিসাব হবে কেবল পথ বনাম বিপথের। কোনো ধর্মেরই বিশ্বাস নিয়ে নিয়মিত নামাজ বা প্রার্থনা করা মানেই বিপথে যাওয়া নয়। নিজের পথকেই একমাত্র সঠিক পথ ভাবা এবং সেই পথে বাকি সবাইকে আসতে বাধ্য করার চেষ্টা করাটাই বে-পথ। আর সেই চেষ্টায় যদি থাকে মানবহত্যার মতো তরিকা—যত দূর বুঝি সব হিসাবেই সেটা ক্ষমাহীন সর্বোচ্চ পাপ। সেটা মগজ ধোলাইয়ের জন্যই হোক আর প্রেমে প্রত্যাখ্যান পেয়েই হোক। ওখানে কোনো ধর্ম নেই। নিজেদের সঠিক প্রমাণের মচ্ছবে এই সামান্য সত্যটুকু বাংলাদেশের তরুণের মাথায় ঢোকাতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের মুরব্বিগণ।
আমরা মুখর হলেও এতটাই অন্ধ ও বধির যে বছর পেরিয়ে গেলেও আজও শুনি সেই একই কথা, তরুণেরা পড়ে না। কিন্তু আজ অবদি একটি জঙ্গি আস্তানা বেরিয়েছে, যেখানে পাওয়া যায়নি যাকে বলা হয় ‘জিহাদি বই’? একজন ব্লগারকে হত্যা করা বা হুমকি দেওয়া হয়েছে, যার ব্লগে আছে কেবল প্রেমের কবিতা বা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর গল্প? কেবল আপনার লেখা বই বিক্রি হচ্ছে না বলেই বলে দিচ্ছেন, কেউ পড়ে না। আসলে ঠিকই পড়ে! সবই পড়ে! সে কারণেই ডাক দেওয়ার জন্য বেছে নিতে পারে তসলিমা নাসরিনের মতো কাউকে, অন্য কাউকে নয়। ব্লগের ক্ষেত্রেও তাই। কে কী পড়ছে, সেটাও মুখ্য হওয়ার কথা নয়। কে পড়াচ্ছেন, সেটাই মুখ্য! রেকর্ড বলে, যাঁরা পড়াচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু তরুণ নন।
মজার (যদিও ‘মজার’ শব্দটা ব্যবহার করতে কষ্ট লাগছে) বিষয় হচ্ছে, আমাদের, মানে বাংলাদেশের তরুণদের প্রগতিশীল মুরব্বিরা কিন্তু সচরাচর বলেন না, ভালো ভালো লেখকের বইয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বইগুলোও পড়ে রাখা দরকার। একই সঙ্গে পড়ে নিয়ো পবিত্র কোরআন, বাইবেল, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা; পারলে থেরি গাথাতেও চোখ বুলিয়ে নিয়ো। তাহলে তোমার সামনেই খুলে যাবে কে কার নামে তোমাকে কী বোঝানোর চেষ্টা করছে। কোন হুকুমের অর্থ তোমার সামনে কীভাবে মেলে ধরছে।
এখানে আসে আরেক অভিযোগ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন করা ছাড়া গতি নেই। আমি তো দেখি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন পিতা-পুত্রের সম্পর্কের চেয়েও শক্তিশালী। নইলে একজন বিশ-একুশ বছরের তরুণ কীভাবে ভারী অস্ত্র বা গ্রেনেড চালানো শিখতে পারে? শিখতে পারে নিজের জীবনও তুচ্ছজ্ঞান করা? এখানেও কে শিখছে তারচেয়ে কারা শেখাচ্ছেন, সেটা বের করা জরুরি। এঁরাও কিন্তু তরুণ নন।
এক, দুই, তিন করে ধরে ধরে এমন বাংলাদেশের তরুণের নামে আরও অনেক ঢালাও অভিযোগেরই উল্টো পিঠ খুলে লেখা সম্ভব। কিন্তু এই লেখাটাও আমাকে লিখতে হচ্ছে লজ্জায় মাথা নিচু করে। আমিও তো সেই একই মুরুব্বি বনাম তরুণ ধরনের একটা বাজে তর্কে ঢুকে পড়লাম।
প্রয়োজনে আমরা এক হতে শিখতে পারিনি বললে ইতিহাস অভিশাপ দেবে। তবে অপরাধ হবে যদি না বলি, আমরা এক হতে ভুলে গেছি।
বাংলাদেশের বতর্মান তরুণ ব্যর্থ একটি প্রজন্ম বললে আমি নিজেই যেমন আঘাতপ্রাপ্ত হব, দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব, ঠিক তেমনি কষ্ট চেপেই বলব, আমার হাতে মোমবাতি ঠিকই আছে, একটু বাদেই ঘোর রাত্রি নামবে জেনেও আগুন হাতে যারা ছিলেন, এই সন্ধ্যায় তারা কেউই এসে আমার মোমবাতি জ্বালিয়ে দেননি।
অনিক খান: ছড়াকার, সাংবাদিক।