
রংপুর থেকে বাসে দিনাজপুর যাওয়ার পথে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ধানখেত দেখে যে কারোরই মন খারাপ হবে। এই ক্ষতি রংপুর বিভাগের সব জেলাতেই হয়েছে। এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ক্ষতি সামলে ওঠা অসম্ভব। গত শুক্রবার দিনাজপুরে যখন পৌঁছালাম তখন শহরে বন্যার পানি অনেকটাই নেমে গেছে। পানি কমলেও দুর্ভোগ এখনো আছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এখনো বন্যার্ত মানুষেরা বাড়ি ফিরতে পারেনি। গত শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ শহর ছিল জলমগ্ন। সেখানে অনেকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা সবাই বলেছেন, এ বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়েও ভয়াবহ। সেই সঙ্গে তাঁরা এ কথাও বলেছেন, ১৯৮৮ সালে যত বৃষ্টি হয়েছিল তার চেয়ে কম বৃষ্টিতে এ বছর বেশি বন্যা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এত বন্যা দিনাজপুরে গত ২০০ বছরেও হয়নি।
বন্যা হবে। বর্ষায় উজান থেকে প্রচুর পানি ভাটিতে নেমে আসবে—এটা স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয়কে মেনে নিয়ে ক্ষতি যাতে কম হয় সেই প্রস্তুতি আমাদের থাকা জরুরি। আমরা সেই প্রস্তুতির পরিবর্তে স্বল্প পানিতে কী করে ভয়াবহ বন্যা হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করেছি। দিনের পর দিন নদীগুলোকে সংকুচিত করতে করতে অনেক নদীকে মেরে ফেলেছি। অনেক নদী মরার উপক্রম।
দিনাজপুর শহরে মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চবিদ্যালয় এখন বন্যার্ত মানুষের একটি আশ্রয়কেন্দ্র। মাঠে কথা হচ্ছিল রেণু দাস ও মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে। রেণু দাস মেয়ে, অসুস্থ নাতনি আর শিশু নাতিকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। স্কুলে এসে আশ্রয় নিয়ে কিছুটা রক্ষা পেয়েছেন। সাত দিন ধরে ওখানেই আছেন। হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে। তিন বেলা খাবার জোটে না। বাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখন কাদা, দুর্গন্ধ আর সাপের উৎপাতে উঠতে পারছেন না। বন্যার পানি নেমে গেলেও কষ্ট এখনো নামেনি। এ অবস্থা দিনাজপুরের অনেক স্থানেই। সারা দেশের বন্যাদুর্গত মানুষের মতো এখানেও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে বন্যার্ত মানুষেরা।
আবহাওয়াবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক আগে থেকেই মধ্য আগস্টে ভয়াবহ বন্যার কথা বলেছে। গণমাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে তা প্রচার করেছে। সরকারও বলছে তাদের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে সরকারের প্রস্তুতি সন্তোষজনক নয়। সরকারের বক্তব্য ঠিক হলে আমাদের মনে করতে হয়, যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তবে বেসরকারিভাবেও সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
দিনাজপুর শহরের অধিকাংশ এলাকা এ বছর বন্যায় ডুবেছিল। সদর উপজেলা চিরিরবন্দর, বিরল, খানসামা, কাহারোলের অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। দুর্গত মানুষের পাশে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অনেকেই বন্যার্ত লোকজনের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ রকম কয়েকটি স্থানে সাংসদ ইকবালুর রহিমের উদ্যোগে ত্রাণের ব্যবস্থা উল্লেখ করে ব্যানার টানিয়ে দেওয়া আছে। এ ছাড়া সাধারণদের সমন্বিত চেষ্টায়ও কয়েক স্থানে রান্না করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ রকম প্রচেষ্টা ব্যাপকভাবে করতে পারলে বন্যার্তদের জন্য খুব উপকার হতো।
শহরের দক্ষিণ বালুবাড়িতে কথা হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ডিজিএম তানজিম ইবনে মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলছেন, ‘বন্যার প্রধান কারণই হচ্ছে নদী খনন না করা। আমাদের যে ঘাগরা খাল আছে, তা মানুষ দখল করেছে। বর্তমানে যে খাল আছে, আমরাই ছোটবেলা এর চার গুণ দেখেছি। সে খাল গেল কোথায়?’
পুনর্ভবা নদীর কাঞ্চন সেতুর কাছে গিয়ে অন্য রকম অভিজ্ঞতা হলো। নদীর পাশে শহর রক্ষা বাঁধে রান্না হচ্ছে দুর্গত মানুষের জন্য। সে সবের তদারকি করছেন মনু মিয়া আর ইব্রাহিম খলিল ওরফে বিচ্ছু মিয়া। মনু মিয়া আশঙ্কা করছেন আগামী ১০-১২ বছরের মধ্যে পুনর্ভবা নদী মানুষের দখলে শেষ হবে। মনু মিয়া নিজেও নদী দখল করে বাড়ি করে আছেন। তাঁর ভাষ্য হচ্ছে, যাদের বাড়ি নদী ঘেঁষে তারা প্রতিবছর একটু একটু করে দখল করছে। মনু মিয়া আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই দখল করার প্রক্রিয়া দেখান। পুনর্ভবার পাশে নদীতে অবৈধ চার-পাঁচ শ বাড়ি। মনু মিয়া বলছেন, ‘১০ বছর আগে কেয়ার এনজিও আমাদের রাস্তা আর ল্যাট্রিন করি দেছে। সরকার আর তুলবার পারবে না।’ প্রশাসন কী করে এ প্রশ্নের জবাবে বিচ্ছু মিয়া বলে, দখলদারদের উচ্ছেদ করলে ভোট পাওয়া যাবে না। তাই তাদের কিছু বলেন না মেয়র।
কাঞ্চন সেতুর ওপর কথা হলো জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী বাবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘শুধু শহরের দিকে পুনর্ভবার বাঁধ আছে। অন্যদিকে নাই। দুদিকে শক্ত বাঁধ থাকলে বিরল উপজেলায় এত বন্যা হইত না।’ এ বছর পুনর্ভবার পানিতে বিরল এবং কাহারোল উপজেলা ডুবে গেছে। দিনাজপুর-পঞ্চগড় রেললাইনের নিচের মাটি পানির স্রোতে ধুয়ে গেছে। রেল যোগাযোগ এখন বন্ধ।
গর্ভেশ্বরী নদীর পাশে খামার কান্ত বাগে শহর রক্ষা বাঁধে কথা হলো কমিজুদ্দিনের সঙ্গে। সেখানে শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। এ রকম বাঁধ ভেঙেছে কয়েকটি স্থানে। আত্রাই থেকে প্রচুর পানি এসে গর্ভেশ্বরী নদীতে চাপ সৃষ্টি করেছে। সেই পানির চাপ শহর রক্ষা বাঁধ ভাঙার কারণ। গর্ভেশ্বরী মৃতপ্রায় হওয়ার কারণে তার পানি বহন করার ক্ষমতা নেই। খামার কান্তবাগে একটি স্লুইসগেট আছে। সেই স্লুইসগেটে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সামান্য একটি স্থানে পানির স্রোতে প্রায় ৭০-৮০ জন নারী-পুরুষ মাছ ধরছেন। মাছ কিনতে আসা লোকের সংখ্যা অনেক। একজন বলছেন, গত কয়েক দিনে কেউ কেউ ৩৫-৪০ হাজার টাকার মাছও ধরেছেন। বন্যায় ডুবে যাওয়া বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা মাছ এগুলো। একজন বলছেন, দুদিন আগে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে এখানকার মাছ।
ওয়ার্কার্স পার্টির দিনাজপুর জেলার সভাপতি আবদুল হক বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে দিয়ে নদী রক্ষা করতে হবে। খনন করে নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে। স্বল্প মেয়াদে সহযোগিতা, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চাই।’ শহরের খাল, পার্শ্ববতী পুনর্ভবা, আত্রাই ও গর্ভেশ্বরী যদি খনন করা না হয় তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে দিনাজপুরের সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে এর চেয়েও কম বৃষ্টিতে বন্যা হবে। আমরা বন্যার পানি নেমে গেলেই মনে করি বন্যার্ত মানুষের বিপদ কেটে গেছে। বাস্তবে তাদের কষ্টের রেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তাই বন্যা-পরবর্তী কষ্টের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাদের সহযোগিতা করা একান্ত জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।