এবার ধানে চাল নেই!

হাওরাঞ্চল, টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুরসহ দেশের অনেক এলাকা থেকে ধানের শিষ পচা রোগ বা নেক ব্লাস্টের খবর আসছে। তিন সপ্তাহ ধরে টিভি ও সংবাদপত্রে প্রচারিত গ্রামবাংলা আর ধান ফসলের খবর ও ছবির প্রায় ৪০ শতাংশজুড়েই আছে ছত্রাক আর চিটা ধানের খবর। দূর থেকে ফসলের খেত দেখে মনে হবে ধান পাকছে, হলুদ হচ্ছে শিষ। এই হলুদ সোনালি নয়, পাণ্ডু রোগের হলুদ সর্বনাশের রং। 

নেক ব্লাস্ট কি নতুন কিছু?

গত বছর কি তার আগের বছরের এই সময়ের দৈনিকের পাতায় পাতায় প্রায় একই রকমের খবর ছিল। কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শের ঝাঁপি খুলে বসেছেন। কীটনাশক ব্যবহার করতে বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, ‘বোকা কৃষক বোঝে না, মাত্রা ঠিক রেখে বিষ দিলে কি ছত্রাক থাকে? আমরা লেখাপড়া করেছি না? এমনি কি বলে, বোকার ফসল পোকায় খায়?’ প্রায় সব খবরে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা এবারও প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের কাছে। পরামর্শ দিচ্ছি, দিয়েই যাচ্ছি—মাত্রামতো কীটনাশক দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সর্বনাশ ঠেকানোর আর কোনো পথ এখন খোলা নেই। বড্ড দেরি হয়ে গেছে।  তবে করার ছিল অনেক কিছু।

শিষ পচা বা নেক ব্লাস্টের আগে ছত্রাক পাতায় আক্রমণ করে। সেটাকে বলে পাতা ব্লাস্ট—ধানের পাতায় মানুষের চোখের আদলে একধরনের ছাপ পড়ে, এটাই সর্বনাশের প্রাথমিক আলামত। ব্লাস্ট ধানের ঘাড় (নেক) মটকানোর আগে পাতা থেকে ধানগাছের গিঁট বা নটে আক্রমণ করে, সেটাকে বলে গিঁট ব্লাস্ট বা নট ব্লাস্ট। এটা দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ। এই দুই পর্যায়ের ছত্রাক ধ্বংস করতে না পারলে চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন ঘাড় কামড়ে ধরে, তখন আর কিছু করার থাকে না।

মাঠ তৈরি থেকে ধান পাকা পর্যন্ত তিন-চার মাসের পরিশ্রম আর ধারকর্জ করে করা বিনিয়োগ সব বৃথা হয়ে যায়। ধানখেত নিয়মিত পরিদর্শন করলে ছত্রাক অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করা, কৃষকদের তথ্য-পরামর্শ দেওয়া এবং মাঠের হালফিল অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো। ছত্রাক ধানের শিষের ঘাড় মটকানোর অনেক আগে প্রথমে পাতায়, তারপর কাণ্ডে আক্রমণ চালায়। এ দুই পর্যায়ে ছত্রাকের আগ্রাসন বন্ধের সুযোগ অনেক বেশি থাকে। নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করলে আজ এই সংকট তৈরি হতো না। 

কোন জাত বেশি আক্রান্ত হয়েছে?

সারা দেশের খবর বলছে, ব্রি-২৮-এ নেক ব্লাস্টের আক্রমণ ঘটেছে ব্যাপক হারে। ১৯৯৪ সালে ব্রি-২৮ বোরো মৌসুমের আগাম জাত হিসেবে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়। ১৪০ দিনের এই ধান ব্রি-২৯ থেকে প্রতি হেক্টরে দেড়-দুই টন কম উৎপাদিত হলেও এটা অপেক্ষাকৃত সাদা আর চিকন হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রি-২৯ থেকে তিন-চার সপ্তাহ আগে এই ধান কাটার উপযোগী হয় বলে মানুষ এটা পছন্দ করে বেশি।

গত বছর হাওরাঞ্চল, দিনাজপুর আর চলনবিলের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এবার আগাম জাত ব্রি-২৮-এর পক্ষে প্রচারও বেড়ে যায়। কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী বোরো মৌসুমে দেশের মোট আবাদি জমির ৪১ শতাংশ জমিতে ব্রি-২৮ চাষ হওয়ার কথা। আগের বছরগুলোতে ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯—এ দুই জাত মিলিয়ে ৬৫ থেকে ৬৭ শতাংশ জমিতে বোরো চাষ হতো। এবার ব্রি-২৮ এককভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি দখল করে নেয় বলে অনেকের ধারণা। 

আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী?

চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বীজের ওপর চাপ বাড়ে। এবার বীজের দামও চড়া ছিল। চড়া দাম আর বেশি চাহিদার ফোকর দিয়ে নিম্নমানের বীজ বাজারে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বলে রাখা ভালো, বীজের বাজারের ওপর বিএডিসি কিংবা সিড সার্টিফিকেশন এজেন্সির নিয়ন্ত্রণ এখন এতটাই ঢিলা যে সাবেক একজন মহাপরিচালক (কৃষি সম্প্রসারণ) এটাকে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা নেক ব্লাস্টের ব্যাপক সংক্রমণের কারণ হিসেবে বলেছেন: ছত্রাকের অনুকূল আবহাওয়া, রাতে কম গরম দিনে বেশি গরম, বৃষ্টি, ঝড়, কুয়াশাভাব, মৃদুমন্দ বাতাস, বেশি ইউরিয়া, কম পটাশের ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কয়েক বছর ধরে এ রকম গৎবাঁধা ব্যাখ্যাই দেওয়া হচ্ছে, চলছে। কিন্তু তাহলে অন্য জাতের বোরো ধান (দেশি জাত বাঁশফুল কিংবা ব্রি-২৯) ব্লাস্টের কোপানলে পড়ল না কেন? জামালপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আমিনুল ইসলাম বলেছেন, ব্রি-২৮ আগাম ধান পুরোনো জাতের ধান, এর রোগবালাই প্রতিরোধ করার শক্তি ক্রমশ কমে গেছে। এটাই বিজ্ঞানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।

গত বছর নেক ব্লাস্ট রোগের কারণে হাহাকার উঠলে মাঠপর্যায়ে রোগের প্রকৃতি, জীবাণুর ধরন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর শেরেবাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা যৌথ তদন্ত দল গঠন করা হয়। কৃষিবিজ্ঞানী তোফাজ্জেল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত এই দল দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাতটি জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তাদের তদন্ত গবেষণা শেষ করে। এই দলেরও ধারণা, জাতটি একনাগাড়ে কয়েক বছর যাবৎ ব্যাপক হারে চাষ করায় এর রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। 

তাহলে উপায় কী?

সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ব্রি-২৮-এর নটে গাছটা একেবারে মুড়িয়ে দেওয়া। যথেষ্ট হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে যখন বারবার ব্লাস্ট এই জাতটাকে কুপোকাত করে দিচ্ছে, তখন বিকল্প ভাবা বা জাতটাকে হালনাগাদ করা উচিত ছিল। হয়তো কাজ চলছে, কৃষিবিজ্ঞানী তোফাজ্জেল কমিটির সুপারিশটাও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এই কমিটির প্রতিবেদনটি দেশের মানুষের জানার জন্য প্রকাশ করা। ইতিমধ্যে উদ্ভাবিত ও  মাঠপর্যায়ে পরীক্ষিত নতুন জাত ব্রি-৫৮ ও ব্রি-৬৩ দিয়ে ব্রি-২৮–কে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।

নতুন সফল ধান ব্রি-৮১ ও ব্রি-৮৪ দ্রুত কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রজনন বীজকে ভিত্তি বীজ ও প্রত্যয়িত বীজের সিঁড়ি ভেঙে কৃষকদের কাছে একটা নতুন বীজ পৌঁছাতে তিন থেকে চার বছর সময় লেগে যায়।

গত বছর নিশ্চিত হওয়া নতুন উদ্ভাবিত ব্রি-৮১ ধানের ব্যাপারে কৃষিবিজ্ঞানীরা অনেক আশাবাদী। ইরানি ধান আমল-৩-এর সঙ্গে ব্রি-২৮-এর সংকরায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত এই জাত কৃষকের ঘরে পৌঁছানোর জন্য সহজ ও গ্রহণযোগ্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংগঠিত কৃষকদল ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার আদর্শ কৃষকদের নিয়ে প্রত্যয়িত বীজ আগামী মৌসুমের আগেই কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

কৃষির শক্তি কৃষকের শক্তি। রোগবালাই সহনীয় বীজ বিশ্বাসযোগ্য বীজ। আগে কৃষক নিজের বীজ নিজেই রাখতেন, দায়দায়িত্বও ছিল তাঁর। খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র যখন সেই দায়িত্ব নিয়েছে, আর এই ব্যবসায় লাভের গুড়ের হিস্যা নেওয়ার জন্য যখন পুঁজি নিয়ে নানা উদ্যোক্তা হাজির, তখন নিয়ন্ত্রণটাও শক্ত হাতে নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই।

গওহার নঈম ওয়ারা , ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক