এরশাদের জন্মদিন ও বহুব্রীহি সমাস

বিরোধীদের দুর্গে আপন জয়পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন এরশাদ। মধুর ক্যানটিন ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের দিশারি সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্র। সেখানে লাস্যময় এরশাদের ছবিতে বেলুন ঝুলিয়ে কেক কেটে জন্মদিন পালন চাট্টিখানি কথা নয়। কয়েক দিন আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘এটা সবার জানা দরকার যে পুরুষ মানুষের বয়স হয় না।’ ৮৭তম জন্মদিনে তিনি প্রমাণ করলেন, রাজনীতির আসল পুরুষ একজনই। তাঁর নাম লে. জে. (অব.) হু. মু. এরশাদ। বখতিয়ার খিলজি নাকি মাত্র ১৭ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে বঙ্গ জয় করেছিলেন। বিডিনিউজ২৪.কমের ছবিতে দেখা যায়, এরশাদের চিত্রবৎ উপস্থিতিকে গোনায় ধরলে মধুর ক্যানটিনে কেক কর্তনকারী বীরের সংখ্যা ১৭ই হয়।

সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঢাবিতে এরশাদ ও তাঁর জাতীয় ছাত্রসমাজকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অলিখিত সেই নিষেধাজ্ঞাকে এত দিন সম্মানই করে এসেছে। মধুর ক্যানটিনে জন্মদিন পালন সেই নিষেধাজ্ঞার প্রতি পরিহাস। এমন পরিহাসেও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম প্রধান সংগঠন ছাত্রলীগ মনে হয় না দুঃখ পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একচ্ছত্র অধিপতির এ বিষয়ে তেমন জোরদার প্রতিক্রিয়া নেই। থাকবেই বা কীভাবে? প্রথমত, ছাত্রলীগের অনুমতি ছাড়া জাতীয় ছাত্রসমাজের লোকেদের মধুর ক্যানটিনে আসতে পারার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, এই এরশাদ তো সেই এরশাদ নন, এই এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শোভাও তো তিনি ও তাঁর দল। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের জন্মদিন মধুর ক্যানটিনে উদ্‌যাপিত হওয়ায় ছাত্রলীগের তাজ্জব বনা উচিত হয় না। নতুনেরা হয়তো ভুলে গেছেন, ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশের ট্রাকচাপায় নিহত হওয়া সেলিম ও দেলোয়ার ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। ঠিকই, এই এরশাদও সেই এরশাদ নন, এই ছাত্রলীগও সেই ছাত্রলীগ নয়। এই দুনিয়াও এখন আর সেই দুনিয়া নাই।

শহীদ রাউফুন বসুনিয়া এখন এক মলিন ভাস্কর্যের নাম, অবহেলায় ঢেকে যাচ্ছে শিক্ষক ক্লাবের উল্টো দিকের রাস্তার ধারে। ডা. মিলনের স্মৃতিমঞ্চও কালের সাক্ষী হতে হতে নীরব। শুধু একটু দূরে শহীদ মিনারকে দেখা যায় মাথা নিচু করে রাখতে। শহীদ মিনারের মাঝের সৌধটি মাতৃভাব ধারণ করে। শহীদমাতা কি দুঃখে না পরাজয়ে নত হলেন? ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির নিহত মানুষের সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। অনেকের লাশ পুলিশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গুম করেছিল। তারা আর উঠে আসতে পারেনি। জয়টা বেহাত হয়ে গিয়েছিল। জয়ী হয়নি জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, আইয়ুব, কাঞ্চন, দীপালিদের মতো শহীদের প্রাণদান। সেই ইতিহাস ভুলিয়ে-ভালিয়ে পরাজয়টাকেই জয়ের মোরব্বা বানিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল; আমরা খেয়েওছিলাম। যে জাতিকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করে রাখা যায়, তারা বারবার হারবে এবং জয়ী শক্তির হাত থেকে পরাজয়ের তাজ নিয়ে মাথায় পরবে। এ জন্যই জয়ের উদ্‌যাপনের পাশাপাশি পরাজয় মনে রাখা ভবিষ্যতের জয়ের শর্ত।

নব্বইয়ে সামরিক শাসকের পতনকে গণতন্ত্রের জয় বলে উদ্‌যাপন করা হয়। কোন গণতন্ত্র, যে গণতন্ত্রে নির্বাচন জিনিসটাই প্রায় বিলুপ্ত! যে গণতন্ত্রে স্বৈরাচারী এরশাদ রাষ্ট্রের কপালে তিলকের মতো জ্বলজ্বল করেন? যে গণতন্ত্রে মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদ নিভু নিভু? এই বাংলাদেশ কি আশির দশকের আন্দোলনের ফসল, নাকি তার পরের আপসের পরিণতি? অথচ কত রকমের চেতনা আমাদের। গণতন্ত্রের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইসলামের চেতনা। আমেরিকাকে বলা হয়, লিবার্টি যেখানে স্ট্যাচু হয়ে আছে; বাংলাদেশ হলো সেই দেশ, চেতনা যেখানে আফিমের কাজ করে।

বাংলাদেশে এখন ফিরে এসেছে এরশাদের রাজনৈতিক একচেটিয়াতন্ত্র। ফিরে এসেছে উৎপাদিকা শ্রেণিগুলোকে কোণঠাসা করে কেবল সড়ক-সেতুনির্ভর উন্নয়ন। আইয়ুব খানও তো উন্নয়নের দশক চালিয়েছিলেন। অনেক ব্রিজ-কালভার্ট তিনিও বানিয়েছিলেন। এরশাদও তাঁর আমলকে উন্নয়নের দশকই বলতে চাইতেন। আশির দশকে প্রবাসী শ্রমিকের বাজার খোলা এবং পোশাকশিল্পের ভিত্তি স্থাপনের যে কথা বলা হয়, তাতে রাষ্ট্রের চাইতে স্বাধীন উদ্যোক্তাদেরই অবদান বেশি। ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের’ এরশাদীয় মডেলই আমাদের বর্তমান নীতি। সুতরাং, কে বলে এরশাদ পরাজিত? পরাজিত হলে তাঁকে চিঠি লিখতে হতো জেলখানার ঠিকানায়। এখন লিখতে হবে জাতীয় সংসদের ঠিকানায়, খামের ওপর লেখা থাকবে তাঁর অদ্ভুত উপাধি: ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত’। এক লোক একই সঙ্গে সরকারি (আদা) ও বিরোধী (কাঁচকলা) হন কী করে? আদা ও কাঁচকলা একসঙ্গে মেশালে তীব্র দুর্গন্ধ হয়।

ব্যক্তি এরশাদ এবং তাঁর রাজনৈতিক ভাবধারাকে পরাজিত করা যায়নি বলেই তিনি এখন রাজনীতির তৃতীয় শক্তি এবং বারবার বিজয়ী জনপ্রতিনিধি। কিন্তু এরশাদ সব পারেন। তিনি বিড়াল ও বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকে একসঙ্গে হাসাতে পারেন। জেলে থেকেও বিপুল ভোটে একাধিক আসনে জয়ী হন। গণতন্ত্রে পরাজয় মেনে নেওয়াই রীতি। তাতে বাস্তবতাটা ‘জ্ঞান’ হয়। আমরাও মেনে নিলাম। চেতনার আফিমের ঘোর কাটাতে মধুর ক্যানটিনে এরশাদের জন্মদিন উদ্‌যাপন তাই উত্তম হয়েছে। যাদের নাক আছে তা কাটা পড়ুক, যাদের লজ্জা আছে তাদের লজ্জা হোক, যারা বেহুঁশ তাদের হুঁশ ফিরুক।

এরশাদ যেহেতু নির্বাচন করার অধিকার হারাননি, তাঁর দল যেহেতু বৈধ এবং তিনি যেহেতু সরকারের খুবই সম্মানিত পাত্রমিত্র, তাহলে কেন তাঁর অনুসারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল-সমাবেশ করতে পারবে না? এরশাদকে এত দূর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত গোমর রেখে কী লাভ? তো একরকম সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় মধুর ক্যানটিনে তাঁর অভিষেক ঘটল। এরশাদ ও গণতন্ত্র এখন আর দ্বন্দ্ব সমাস নয়। যে গণতন্ত্র এরশাদের, তা এক বহুব্রীহি সমাস। যে সমাসে দুই পদের অর্থ বড় না হয়ে তৃতীয় অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে বলে বহুব্রীহি সমাস। যেমন দশ মাথা (আনন) যার, সে দশানন। কিন্তু দশানন বলতে কোনো দশ মাথাওয়ালা লোক বোঝায় না, বোঝায় একমাত্র রাবণকে। যে গণতন্ত্রের শোভা এরশাদ ও তাঁর জন্মদিনের বেলুন, তাকে আমরা কী নাম দেব? বহুব্রীহি সমাসের নিয়মে এখানে গণতন্ত্র ও এরশাদের চাইতেও তৃতীয় কোনো পদ বা নাম বড় হয়ে ওঠার কথা। সেটা কী? ধাঁধাটা দিয়ে গেলাম। বহুব্রীহি সমাসের নিয়মে উত্তরটা বের করে নিন।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক  লেখক