এর চেয়ে তো হোম অফিসই ভালো ছিল

এক ঘণ্টা ধরে সংসদ ভবনের সামনে বসে আছি। গাড়ির চাকা একদম স্থির। সবকিছু স্থবির হয়ে আছে। আমার জীবনে এর আগে এই জায়গায় এই রকম ঘটেনি। অন্তত হাত দুয়েক হলেও গাড়ি এগিয়েছে। ড্রাইভার বলল, আর এক ঘণ্টা পর কারওয়ান বাজার পৌঁছাতে পারি।

আমি বললাম, পারি। যদি গাড়ির চাকা ঘোরে। না ঘুরলে কীভাবে যাবা?

ঠিক এই সময় আমার এই অনুভূতি হলো, এর চেয়ে তো হোম অফিসই ভালো ছিল। নিজের ঘরে বসে অনলাইনে অফিস করতাম। যানবাহনে উঠতে হতো না, যানজটেও পড়তে হতো না।

আচ্ছা, আপনারা যাঁরা সড়কপথে ময়মনসিংহ যান, তাঁরা যান কীভাবে? কিংবা যাঁরা গাজীপুর যান, কেমন করে যান? এটা কি রাস্তা, নাকি খানাখন্দময় পাথুরে পাহাড়! ঢাকা থেকে পুবাইল যাচ্ছিলাম টঙ্গী হয়ে, বিমানবন্দর পেরিয়েই যানজট, গুগল ম্যাপের পরামর্শে উত্তরার ভেতরে ঢুকে গিয়ে টঙ্গী সেতুর কাছে পৌঁছালাম বটে, তারপর তো আর চলবার উপায় নেই! রাস্তায় নির্মাণকাজ চলছে এবং যানবাহন স্থির হয়ে আছে। ফেরার সময় ভাবলাম, পূর্বাচল দিয়ে আসি। সেই রাস্তাও তো নির্মাণাধীন। রাস্তায় বড় বড় গর্ত এবং পানি ভরা গর্তগুলো দেখতে পুকুরের মতো। এখনো স্কুল-কলেজ খোলেইনি, তাতেই ঢাকার রাস্তায় চলা যাচ্ছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে রাস্তার কী অবস্থা হবে?

আমি এই সমস্যার একটা সমাধান প্রস্তাব করছি। এর আগে আমরা করেছি হোম অফিস, অনলাইন স্কুল। এবার আমরা করব অফিস হোমিং, স্কুল হোমিং। আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে কোনোরকমে অফিসে গিয়ে পৌঁছাব আর সেখানেই থেকে যাব। বিছানা-বালিশ নিয়ে যাব সঙ্গে করে। রাতের বেলা অফিসের মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ব। আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখব অনলাইনে। ভার্চ্যুয়াল হোমিং। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীরা যদি একবার পৌঁছাতে পারে, তাহলে আর তারা বাড়ি ফিরবে না। কোথাও যাবে না। ওখানেই থেকে যাবে। বাবা-মায়েরা জুমের মাধ্যমে, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অন্তত মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগে ঢাকার রাস্তায় চলাচল অসম্ভব।

কিন্তু গাজীপুরের কী হবে?

বাংলা নিউজ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

‘২০১২ সালে গাজীপুর থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) আওতায় দেশের প্রথম বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প শুরু হয়। সে সময় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পের নির্মাণকাজের ব্যয় দ্বিগুণ (৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ ১৪ টাকা) করা হয়। এরপর আরও দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময়সীমা করা হয়। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এডিবি, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (ডিইএফ) অর্থায়ন করছে।’

একদিন পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নেবে এবং একদিন পৃথিবী থেকে গাজীপুরের রাস্তার গণদুর্ভোগ চলে যাবে। তত দিন লোকে নিশ্চয়ই চাঁদে বসবাস শুরু করবে, চাঁদে গিয়ে মানুষ দেখবে, সেখানে আগে থেকেই বাঙালি আছে, সেখানে বাঙালি সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ আছে এবং সেখানে গাজীপুরের রাস্তায় কাজ করে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভকারী বাঙালিরা নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে।

মানে এই দুরবস্থা কেনার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আরও হবে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারেন, কাজটা কবে শেষ হবে এবং কাজটা শেষ হলে রাস্তাঘাটের উন্নতি হবে কি না! নাকি প্রকল্প শেষ করার পর দেখা যাবে, বাস্তবে তা কাজে লাগছে না, এটা সংশোধন করতে হবে, তখন আবারও বাজেট বরাদ্দ হবে, আবারও রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি করা হবে?

যা-ই হোক, করোনাও এই পৃথিবী থেকে কোনো দিন যাবে বলে আশা করছি না, গাজীপুরের রাস্তাও কোনো দিন ভালো হবে বলে আশা করি না। আবার আশাবাদী হিসেবে বলা যায়, একদিন পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নেবে এবং একদিন পৃথিবী থেকে গাজীপুরের রাস্তার গণদুর্ভোগ চলে যাবে। তত দিন লোকে নিশ্চয়ই চাঁদে বসবাস শুরু করবে, চাঁদে গিয়ে মানুষ দেখবে, সেখানে আগে থেকেই বাঙালি আছে, সেখানে বাঙালি সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ আছে এবং সেখানে গাজীপুরের রাস্তায় কাজ করে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভকারী বাঙালিরা নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে।

সেদিন কবে আসবে জানি না। আপাতত ঢাকার রাস্তায় চলব কী করে?

কাজেই সরকার বাহাদুর সমীপে আকুল আরজ এই যে অফিস হোমিং এবং স্কুল হোমিং চালু করিয়া সার্কুলার জারি করা হউক। ইহাতে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা বাঁচিয়া যাইবে, রাস্তায় ডিজেল-পেট্রল কম পুড়িবে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হইবে, বায়ুদূষণ হ্রাস পাইবে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা যাইবে। গৃহে গৃহে শান্তি আসিবে, দাম্পত্য সম্পর্ক দৃঢ়তর হইবে।

দম্পতিরা সুখী হইবে, কারণ, তাহারা দূরে দূরে থাকিবে।

প্রথম আলোর ২২ ডিসেম্বর ২০২০-এর খবর।

‘করোনার এই সময়ে ঢাকায় তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে গেছে। এ বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে দৈনিক ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক হয়েছে।’


আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক