এ কেমন ভালোবাসা?
‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি, দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়, বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীল পদ্ম।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় একজন প্রেমিক পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য কী কী করতে পারে তার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। ঠিকই, প্রেমের জন্য কিনা করে মানুষ।
অনেকে ঘর ছাড়েন। অনেকে ধর্মান্তরিত হন। প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে ছুটে আসেন প্রেমিক প্রবর। ভালোবাসার পাত্রীকে নিজের করে না পেয়ে অনেকে সারা জীবন একাকী কাটিয়ে দেন। আত্মহত্যা করেন অনেকে। যেমনটি করেছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার সোহেল রানা। একই গ্রামের এক কিশোরী প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ২৫ বছর বয়সী এ যুবক গত বছর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। প্রেমের জন্য আত্মত্যাগের এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে।
কিন্তু ওবায়দুল খান বা মিলন মণ্ডল প্রেমের জন্য এ কী নজির স্থাপন করলেন! পাঠক, চিনতে পেরেছেন কি এ দুজনকে? প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় ওবায়দুল খুন করেন রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিসাকে। আর মিলন মণ্ডল খুন করেন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবম শ্রেণির ছাত্রী নিতু মণ্ডলকে। পছন্দের মেয়ে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তাদের খুনই করে ফেললেন! এ কেমন প্রেম? এ কেমন ভালোবাসা তাঁদের? এই দুই যুবক কি আদৌ ওই মেয়েদের ভালোবাসতেন? যাকে ভালোবাসে, তাকে কি খুন করা যায়? এটা কি প্রেম, না আক্রোশ? প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দিলে ভালো, না হলে তাকে মেরে ফেল। ভাবটা এমন, আমি পাব, আমি না পেলে এই পৃথিবীর আর কেউ পাবে না।
ওবায়দুল আর মিলনের ভালোবাসা ছিল একতরফা। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য তাঁরা উত্ত্যক্ত করাকে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পছন্দের পাত্রীরা তাঁদের ভালোবাসায় সাড়া দেয়নি। এত বড় দুঃসাহস! আর এই দুঃসাহসই মেয়েদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। মরতে হলো তাদের।
রিসা হত্যার এক মাস না যেতেই খুন হয় নিতু মণ্ডল। যেন ওবায়দুলকে দেখেই হত্যাকাণ্ডে উৎসাহিত হয় মিলন মণ্ডল। একই রকম ঘটনা ঘটেছে গত ৯ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার করিম খাঁ গ্রামে। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় স্থানীয় এক মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করেছেন মহসিন (২৪) নামের এক বখাটে যুবক। ওই ছাত্রীর ভাগ্য ভালো, রিসা ও নিতুর মতো পরিণতি তার হয়নি। বেঁচে গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে মেয়েরা এখন কী করবে? যেকোনো পুরুষের তা সে যোগ্য হোক বা বখাটে হোক, প্রেমের প্রস্তাবে তাদের সাড়া দিতে হবে! বাঁচতে হলে তো তা-ই করতে হবে। মেয়েটি ছেলেটিকে ভালোবাসে কি না, সেটি বিবেচ্য নয়। ছেলেটি মেয়েটিকে ভালোবাসে এটাই বড় কথা। মেয়েদের আবার পছন্দ-অপছন্দ কী?
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা আজও ভোগ্যপণ্য ও অত্যাচার-নির্যাতনের উপকরণ হয়েই আছে। এ সমাজে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে যেন কিছুই নেই। পুরুষ যেমন করে চাইবে, সেভাবেই তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। পুরুষ নারীর ওপর আধিপত্য বজায় রাখবে। এটাই নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটলেই নারীর বিপদ।
কিন্তু এ রকম আর কত দিন চলবে? এর শেষ তো একদিন হতেই হবে। ওবায়দুল, মিলন বা মহসিনের মতো আর কেউ যাতে প্রেমের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারে সে জন্য রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সবাইকে অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজটা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়।