কতটা পরিবর্তন ঘটেছে ২০২০ সালে

শিগগিরই ২০২০ সালের অবসান ঘটবে, কিন্তু তার অভিঘাত দ্রুত শেষ হবে না। অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে ২০২০ সালের অবসান হবে ভিন্ন। এ বছর কোভিড–১৯ মহামারিতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যুসহ এর অন্যান্য ক্ষতচিহ্ন ব্যক্তি, পরিবার, দেশ ও বিশ্বকে অনেক দিন বইতে হবে। একদিকে টিকা আবিষ্কার এবং তা প্রয়োগের কারণে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে ভাইরাসের নতুন ধরন মানবসভ্যতাকে চোখ রাঙাচ্ছে। ২০২১ সাল সেই অর্থে শুরু হবে ভিন্নভাবে, কিন্তু কতটা ভিন্ন হবে পৃথিবী? কতটা পরিবর্তন ঘটেছে ২০২০ সালে?

পৃথিবীর যেসব দেশকে মনে হতো যেকোনো সংকট মোকাবিলার সক্ষমতাসম্পন্ন, গত ফেব্রুয়ারি–মার্চে সারা বিশ্বে মহামারির বিস্তার শুরুর সময়ে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়লে যেমন বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি এ আশাবাদও জেগেছিল যে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তন ঘটবে। করোনাভাইরাসের সৃষ্টি ও বিস্তার প্রকৃতি থেকে—এ তথ্য এমন আলোচনার সূত্রপাত করেছিল যে পৃথিবী প্রকৃতি–বিধ্বংসী উন্নয়নের ধারণা পুনর্বিবেচনা করবে, জনস্বাস্থ্যের বিবেচনা প্রাধান্য পাবে, নতুন মানবিক পৃথিবী গড়া সম্ভব। প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই যে আছে এবং তার ব্যবহার যে আমাদের বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে পারে, সে কথাও বলা হয়েছিল। আবার তা যে নাগরিকের অধিকার সীমিত করতেও পারে, সেই আশঙ্কাও গুরুত্বের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়েছিল।

এমন আশাবাদও ছিল যে করোনা এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করবে। আন্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, বৈশ্বিক রাজনীতিতে ও পৃথিবীর অর্থনীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা এতটাই যে আমরা আর করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে ফিরে যাব না। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা ভয়াবহ সংকটে পড়ার আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

বিশ্বব্যবস্থায় বা ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল দুই কারণে। প্রথমত. চীনের উত্থান, বিশেষ করে কোভিড–১৯ মোকাবিলায় দ্রুত সাফল্য, তাকে মডেলে পরিণত করবে, তা অন্যত্রও অনুসৃত হবে। দ্বিতীয়ত. পশ্চিমা বিশ্বের ব্যর্থতা, বিশেষত ভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং তার আর্থিক সংকট গোটা পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবকে আরও খাটো করবে। গোড়াতে চীন কেবল যে নিজের দেশের ভেতরেই সাফল্য দেখিয়েছে তা নয়, ‘মাস্ক ডিপ্লোমেসি’ অর্থাৎ অন্যদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম, পরীক্ষা কিট সরবরাহ, এমনকি চিকিৎসক পাঠানোর কাজে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তার মধ্যে এমন ইঙ্গিত ছিল যে অনেক দেশই চীনের ওপর নির্ভরশীল হবে। সম্ভবত প্রতিষেধকের জন্যও চীনের দ্বারস্থ হবে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে, চীনের ওপরে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, যা ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চীনের অনূকূলে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার পক্ষে এখনো প্রমাণ নেই, যা আছে তা হলো যারা আগে থেকেই নির্ভরশীল ছিল, তারা এখন অর্থনৈতিক কারণে আরও বেশি চীনের মুখাপেক্ষী হচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খানিকটা বেড়েছে, অন্যদিকে আফ্রিকায় এখন রাশিয়ার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস ভূরাজনীতিতে এখন পর্যন্ত কোনো বিচ্ছিন্ন পরিবর্তন বা ‘ডিসকন্টিনিউয়াস শিফট’ ঘটায়নি। তার অর্থ এই নয় যে মহামারির সময়ে ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন আসেনি। এক দশক ধরে চীনের উত্থান ও অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এশিয়ার দিকে সরে আসছিল, ২০২০ সালে সেই ধারা আরও গতি পেয়েছে। তার কারণ শুধু মহামারি নয়, একাদিক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষয় এবং ২০১৬ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একলা চলার নীতি।

করোনার টিকা তৈরি ও বিতরণের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর সাফল্য এ ভাইরাসকে চীনের পক্ষে ভূরাজনীতি বদলের হাতিয়ারে পরিণত হওয়া থেকে যে রক্ষা করেছে, তা বলা যায়। কিন্তু টিকা রাজনীতির ঊর্ধ্বে আছে বা থাকবে এমন নয়। বরং ইতিমধ্যে ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’-এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব রক্ষা বা পুনরুদ্ধারও ভূরাজনীতিরই বিষয়। টিকা আবিষ্কারের আগে আমরা বিভাজনটি দেখতে পেয়েছি—ধনী দেশগুলো আগেই টিকা কিনে রাখতে পেরেছে, মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বা কিছুর বিনিময়ে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করছে। দরিদ্র দেশগুলোর ভরসা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য এবং টিকা সহজলভ্য হওয়া। ২০২১ সালে যখন ব্যাপক আকারে টিকা প্রদানের সময় আসবে, তখন এ বিভক্তি আরও বেশি প্রকট হয়েই দেখা দেবে। তার মানে মহামারি বিশ্বের ক্ষমতাকাঠামো বদলে দিতে পারেনি।

ক্ষমতা ভারসাম্যের পরিবর্তনের জন্য হেজিমনিক আদর্শের উদ্ভব হয়নি। আগস্ট মাসে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন জার্নালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল ড্রেজনারের গবেষণা প্রবন্ধের শিরোনাম সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্ট করে এ মতকে ধারণ করেছে, ‘দ্য সং রিমেইন্স দ্য সেইম—ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স আফটার কোভিড-১৯’ (গান সেই একই থাকল—কোভিড-১৯–এর পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক)। চীন-মার্কিন সম্পর্কের কোনো বদল ঘটেনি, চীনের গ্রহণযোগ্যতা নাটকীয়ভাবে বাড়েনি, রাশিয়া আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়নি এবং এশিয়ার দেশগুলো এখনো নতুন আঞ্চলিক কাঠামো গড়ে তোলেনি, যা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্পের ধারণা দেয়।

ভূরাজনীতিতে বদলের আরেকটি সম্ভাবনা ছিল যদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ত। অস্বীকারের উপায় নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যথাযথ ভূমিকা পালনে সফল হয়নি, জাতিসংঘ এ সংকটে কার্যত অনুপস্থিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বিতর্কিত করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেষ্টা যে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং নির্বাচনে জেতার কৌশল ছিল, সেটা বোধগম্য ছিল বলেই তার প্রভাব পড়েনি। ভবিষ্যতে অন্যভাবে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু আশা করা যায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দেবে না, সবার সঙ্গেই যুক্ত থাকবে। সংস্কারের প্রশ্ন আশু রাজনৈতিক সুবিধার বিষয় নয়, কার্যকারিতার।

যে প্রশ্ন সামনে এল, সেটা হচ্ছে ভবিষ্যতে ইউনিলেটারিলিজম বা একলা চলার নীতি নাকি মাল্টিলেটারিলিজম বা বহুজাতিক সহযোগিতা বাড়বে। ২০২০ সালের ঘটনাপ্রবাহ বড় দাগে বহুজাতিক সহযোগিতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অর্থনৈতিক সংকটে উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের দেশগুলো বহুজাতিক সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছে। কোভিড-১৯–এর সময়ে আমরা দেখতে পেলাম, স্বাস্থ্য খাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ কতটা দরকার। বৈশ্বিকভাবে যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি তা হচ্ছে, এ সহযোগিতার ক্ষেত্র কী, মাত্রা কতটুকু।

বৈশ্বিকভাবে নেতৃত্বের সংকট সুস্পষ্ট। অতীতে যেকোনো মহামারির সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নেতৃত্বের জায়গায় থেকেছে, এবার সেটা পারেনি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের এ জায়গা অন্য কেউ নিতেও পারেনি। ইউরোপ বিভক্ত ও বিধ্বস্ত। চীনের চেষ্টা তৈরি করেছে সংশয় ও সন্দেহ। রাশিয়া এ দিকে পা বাড়ায়নি।

নেতৃত্বের এ সংকট ও গত এক দশকে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে মাঝারি আকারের বা মধ্যমানের শক্তিধর দেশগুলোর আরও বেশি ভূমিকা পালনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার প্রমাণ জাপানের ভূমিকার সম্প্রসারণ। এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া এ ভূমিকা পালন করতে পারত, যদি তার রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকত। সেই ভূমিকা পালন না করলেও ভারসাম্য বজায়ের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ভারতের আগ্রহ এবং সম্ভবত শক্তি থাকলেও ভারত তার সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয় না। সে দেশে ক্ষমতাসীন বিজেপির সংকীর্ণ অভ্যন্তরীণ অ্যাজেন্ডা ও অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে এবং প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় তার সম্ভাবনা সীমিত।

মধ্যমানের শক্তিগুলোর উত্থান মধ্যপ্রাচ্যে ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্ক প্রায় এক দশক ধরে এ চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে ওই দেশগুলো নিজের বলয় শক্তিশালী করতে আরও বেশি উদ্যোগী হয়েছে। তার পরিণতিতে চীন ও রাশিয়া সেখানে উপস্থিত হয়েছে। বাহরাইন, সুদান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্কো অংশত ট্রাম্প প্রশাসনের চাপে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, কিন্তু এটাও কারণ যে এ উদ্যোগের পেছনে আছে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা। দেশগুলো মেনে নিচ্ছে যে ইসরায়েল একটি আঞ্চলিক শক্তি এবং তাদের সেটা মেনে নিয়ে অন্য ধরনের জোট করতে হবে। ইরান, সৌদি ও তুরস্কের শিবিরের কোথাও তারা জায়গা চায়, এ অঞ্চলে ভারসাম্য রক্ষায় তারা অংশীদার হতে চায়।

সব মিলিয়ে ২০২০ সালে ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেনি, করোনাভাইরাসের কারণে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বড় ধরনের অদলবদল হয়নি। বিশ্ব অর্থনীতি সংকটে পড়েছে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। তবে সেই চেষ্টায় সমাজের বঞ্চিত মানুষের কতটা লাভ হবে, সেই প্রশ্ন বছরের শুরুর দিকে যেমন ছিল, শেষ প্রান্তেও তেমনই থাকল।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর