
কী সুন্দর বন্যা!
টিনের ঘরের কাঠের জানালা। অর্ধেকটা ডুবে পানিতে। যা আগে ছিল বাড়ির হাঁস, এখন তারা সেই আধডোবা জানালা দিয়ে ঘর-বাহির করে। বাড়ির মানুষগুলো কই? কোনো পুরুষ দেখা গেল না। চালার ওপর তেকোনা ছাউনি। তার ভেতর গালে হাত দিয়ে বসে আছে মা ও কিশোরী। নড়াচড়ার ওটুকুই জায়গা। চালের ওপর ফুটে আছে কুমড়ো ফুল। যমুনার ঘোলা পানি চারপাশে করে খলখল, আকাশ দৃশ্যত সুনীল। পানির ওপর জেগে থাকা কলমিগাছের ডগাগুলো ভরে আছে কালো কালো ডাই পিঁপড়ায়। উড়ছে শালিক, চাতক পাখির ঝাঁক দিগ্বিদিক করছে। ভেসে আসা কচুরি মহল্লায় সাদা বক চমকে মাথা তুলছে। বাঁশঝাড়ের মাথায় মেঘধূসর অদ্ভুত সুন্দর বড় পাখি। ডুবে থাকা ধঞ্চেবাগান নিঃশব্দে মাথার শেষটুকু জাগিয়ে আছে। মানুষ-পাখি-পতঙ্গ সবাই ভাসমান।
আহ্, সব কত সুন্দর! যমুনার চরে চরে মাইলের পর মাইল ঘোলা পানির স্রোত। ছিটেফোঁটা বাড়িঘর, একচিলতে লম্বা বাঁধের মতো জমিনে সার বাঁধা গরুগুলো, দুপুরের রোদে সব দিচ্ছে ঝিলিক। সব সুন্দর, যদি চোখটা হয় নির্জীব ক্যামেরার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের লোকদের আর ক্ষমতার, যাঁদের মন বন্যার পানিতেও ভেজে না এতই পাষাণ। কিন্তু যে চোখ দুর্গতদের, যে চোখ দেখতে আসা মানুষের, তা ভিজে উঠবেই, তা স্বীকার করবেই মানুষ বড্ড দুঃখে আছে আজ।
উধাও গ্রামগুলোর নিখোঁজ মানুষেরা
নতুন কোনো মানচিত্র করা গেলে সেখানে এই এলাকাটার কোনো নাম থাকবে না। নামহীন, জনপদহীন, বৃক্ষহীন এক ধু ধু শূন্যতা।
পুরো শূন্যতা এ নয়। আকাশের তলায় এর অর্ধেকটা জলে ভরা, আর বাকি অর্ধেকটা ফাঁপা-ফাঁকা, যা দিয়ে বয়ে যায় হাহাকারের বাতাস। আশাবাদী বলবেন, অর্ধেকটা তো ভরা। অবশ্যই, তবে জলে ভরা।
যমুনা সেতুর পরে সিরাজগঞ্জ পার থেকে বাঁয়ে নেমে মানবমুক্তি সংস্থার ঘাট থেকে ছাড়ল নৌকা। বেলা ১১টা। প্রায় ১০০ ফুট লম্বা নৌকা বানের টান সামলে দুরন্ত গতিতে চলতে পারে। আসতে লেগেছে দুই ঘণ্টা। যমুনা সেতুর উত্তরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের এই এলাকার একটা নাম ছিল কদিন আগে। কয়েক মাইল দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেলানো কয়েকটা চরের একটা জনপুঞ্জি। নামগুলো সুন্দর: উমেরপুর, শৈলদানা, কাঠালিয়া, মাটিয়া সলঙ্গি, বাউশা, মিনাদিয়া। যমুনা নদী আর নিয়তির জিম্মায় রক্ষিত কত নাম। গত কদিনের বন্যায় সব নাই হয়ে গেছে।
দূর থেকে কয়েকটা ভাঙা ঘরের চালা আর বড় কালো একটা নৌকা দেখে এগিয়ে যাই। জলে ও নৌকায় ১৫-২০ জন নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধ কাজ করছেন। উড়ে উড়ে তাঁদের পর্যবেক্ষণ করছে কয়েকটি কবুতর। আকাশে উড়ছে চিল। ঘরবাড়ি নেই। সিমেন্টের চিকন থামগুলো দাঁড়িচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে পানিতে পা ডুবিয়ে।
ছিল হাজারখানেক ঘরের এক বসতি। একটা মাদ্রাসাও ছিল। সেটা ভাঙা হচ্ছে। এক বৃদ্ধ শিক্ষকের তদারকিতে ইতিমধ্যে সব টিন ও খুঁটি নৌকায় তোলা হয়েছে। নৌকার ছইয়ের ওপর খালি গায়ের দুটি মেয়েশিশু, মাদ্রাসারই ছাত্রী। মাদ্রাসাটির নাম ছিল আগবিয়ারপুর মাদ্রাসা। আস্ত মাদ্রাসাটি চলে যাচ্ছে ঢাকার ধামরাইয়ে। বৃদ্ধ ও নাতি দুজনও। অন্য ছাত্রছাত্রী ও তাদের পরিবার কে কোথায় চলে গেছে, তাঁরা জানেন না।
পাশের নৌকাটায় সাংসারিক ধ্বংসাবশেষ। একটা সংসারের সব সেখানে তোলা হয়ে গেছে, হাঁড়ি-পাতিল, বালিশ-তোশক, আলমারি-আলনা, চুলা ও চুঙ্গি। এই সংসারের যুবক রফিকুল ইসলাম জানান, তাঁরা টাঙ্গাইলের দিকে চলে যাবেন। আসার পথে বারোপখিয়া স্কুলে দেখেছিলাম শখানেক পরিবার, তারা এসেছে টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জে। কে কোথায় যাবে, তার কোনো নিয়ম নেই। যে যেখানে পারে।
কলার ভেলার ওপর খড়ের স্তূপ। তাতে দাঁড়ানো ছাপা শাড়ি পরা নারীটি মা সালেহা খাতুন, পাশে দুই মেয়ে শাহনাজ পারভীন আর হোসনে আরা। শাহনাজ পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে। কিন্তু তাদের স্কুলখানা ভেঙে গেছে, বাড়ি চলে গেছে, পড়ালেখা হবে কি আর? সামনেই পরীক্ষা। শিশু থেকে তরুণ-তরুণী কারও পরীক্ষা দেওয়া হবে কি আর? এদের মধ্যে কতজন ঝরে যাবে চিরতরে? কতজন হারিয়ে যাবে শিশুশ্রমে, গার্মেন্টসে, বস্তিতে এবং আরও অন্ধকার কোনো পথে? উত্তর কেউ জানে না।
আসাদ নামের এক মজুর বললেন, ‘বাঁচা লাগব না! ছাওয়াল-পাওয়ালক তো খাওয়ান লাগব।’ হাজার বছর আগে এক বাঙালি কবি খরার মুখে বলেছিলেন, ‘বউ শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে।’ এখন বন্যার মুখে আদমকৃষকের চিন্তা একটাই, ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে হবে, খাওয়াতে হবে।
তবু কোনো হাহাকার নেই। নীরবে ঘরের শেষ খুঁটিগুলো ওপড়াচ্ছে সবাই। গত রোজার সময় তাদের বাড়িটা ছিল আরেক জায়গায়। সেখানে ভাঙন ধরলে এখানে শিকড় পুঁতেছিল সালেহার পরিবার। এখন আবার যাযাবর, নৌকায় চলমান এক বেদেবহর।
কত আপন মানুষ হারায়া গেল!
উমেরপুরের ৫১ নম্বর ইউনিয়নের স্কুলটা ডুবে যাবে বলে ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। একজন ৬৫ হাজার টাকায় নিলামে পেয়েছে, আরেকজনের অধিকার গায়ের জোরের। তার পাশে একচিলতে কয়েক একর লম্বা জমি। ঘর ভাঙা হলেও বাঁশঝাড় আছে, কুমড়ার মাচা আছে। আর আছে শিশুরা। তাদের বড় ভাই রবিউল আলম নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘কত আপন মানুষ হারায়া গেছে। ছাওয়াল থুই বাপ চলি গেছে। আমরা শেষ পর্যন্ত থাকপ, না পারলে পশ্চিমে চলে যাব।’
পশ্চিমে যেদিকে হাত তুলে দেখালেন, সেদিকেও বিস্তীর্ণ জলরাশি।
গরুও কৃষকের আরেক সন্তান। মানুষের খাবার যদিও মেলে, মেলে না গরু-ছাগলের ঘাস, ভুসি, খইল আর তুষ। ডুবে ডুবে তারা পানির তলা থেকে কাইশা ঘাস কাটে। না পেলে কিশোর বয়সীদের ডিঙি নিয়ে পাঠিয়ে দেয়, যেখান থেকে পার ঘাস নিয়া আসো। এই ঘাস খেতে চায় না গরু, ধারালো এই ঘাসে পেট খারাপ হয়, মুখ-গাল কেটে যায়। মানুষের ত্রাণের কথা হয়, কিন্তু গবাদিপশুর ত্রাণের কথা ভাবতে হয় একা কৃষককেই।
গরুর জন্য ঘাস আর নিজেদের জন্য শাক নিয়ে আসছিলেন এক দম্পতি। উজান থেকে ভেসে যাচ্ছিল এক লাল ঘোড়া—দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বিকট অসহায়ত্ব নিয়ে সাঁতরাচ্ছে মাঝ দরিয়ায়। তাকে ধরে আনতে ছুটেছে দুই মাঝি। সস্তায় গরু কিনতে আসছে কোরবানির হাটের ব্যাপারী। আসবে দুধের ব্যবসায়ী। তবু ত্রাণের খোঁজ নেই। চৌহালী উপজেলার ইউএনও জানেন না একটিও হারিয়ে যাওয়া গ্রামের নাম। একজন ডুবে, একজন সাপের কামড়ে মারা গেছে।
পানি নেমে যাবে, তখন ভাঙন আরও তীব্র হবে। মানুষগুলো লড়তে লড়তে তখন ক্লান্ত হবে। রাত জেগে আর গরু পাহারা দেওয়া সম্ভব হবে না। তখনই সময় আসবে ডাকাতের। নৌকা করে তারা আসবে, কৃষক না খেয়ে যে গরুগুলোকে এত দিন বাঁচালেন, তারা হারিয়ে যাবে।
বন্যা নিষ্ঠুর। কত আপন যে তাতে হারিয়ে যায়!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।