করোনাকালে হেপাটাইটিসকে উপেক্ষা নয়

আমরা সচরাচর যকৃৎকে লিভার বলেই চিনি। তাই বিশ্ব যকৃৎ প্রদাহ দিবস বুঝতে অসুবিধা হলেও ‘ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস ডে’ বেশ পরিচিতই মনে হয়। লিভারের প্রধান কাজ হলো খাদ্যের সব উপাদানকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার উপযোগী করে তোলা, গ্লুকোজ, ভিটামিন, খনিজসমূহ ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা, অ্যালবুমিন, রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানগুলো সমন্বয় করা, পিত্তরস তৈরি করে হজমের সময় তা সরবরাহ করা, বিভিন্ন ওষুধ বা বিষাক্ত খাদ্যের বিষক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করা।

সেই লিভারের বিভিন্ন রোগের মধ্যে লিভার প্রদাহে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় এবং তা আবার ভাইরাস দিয়ে। এ, বি, সি, ই—এই চার ভাইরাসই পৃথিবীব্যাপী সচরাচর লিভারকে আক্রান্ত করে। তাই এদের হেপাটাইটিস ভাইরাস বলে।

পৃথিবীতে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষের এমন হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার এর ৯০ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তারা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত। এই রোগ এইচআইভি থেকে ১০ গুণ বেশি ছোঁয়াচে। এ কারণে বছরে প্রায় নয় লাখ লোক হেপাটাইটিস রোগের জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে, যা এখন পর্যন্ত করোনার মোট মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ।

এ, সি, ই হচ্ছে আরএনএ ভাইরাস আর বি হচ্ছে ডিএনএ ভাইরাস। এ আর ই সাধারণত লিভারে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং অল্প দিনেই তা ভালো হয়ে যায়, লিভারে চিরস্থায়ী কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু বি আর সি প্রাথমিকভাবে ক্ষণস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি তো করেই, অনেক ক্ষেত্রে তারা রক্তে দীর্ঘস্থায়ী আবাস গড়ে নেয়, তখন ওই সব রোগী তার আপনজনকে এ রোগ ছড়ানোর পাশাপাশি ১২ থেকে ১৫ বছর পরে রোগীর নিজের লিভারকে ধ্বংস করে সিরোসিস এবং কিছু কিছু ক্ষেত্র বিশেষে লিভারে ক্যানসার তৈরি করে দেয়।

সিরোসিস কিংবা লিভার ক্যানসার অত্যন্ত জটিল, দুরারোগ্য, চিকিৎসার অযোগ্য ব্যাধি। এ, ই পানি বা খাদ্যবাহিত আর বি, সি রক্তবাহিত, মানে সুই, কাঁচি, ব্লেড বা সংক্রামিত মানুষের রক্ত বা সেক্সের মাধ্যমে ছড়ায়। বি ও সি ভাইরাস এমনকি সংক্রামিত মা থেকে প্রসবকালে নবজাতককেও সংক্রামিত করতে পারে। তার মানে হলো আমাদের অজ্ঞতা আর অবহেলার কারণে সুস্থ ব্যক্তিরাও এসব ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে নিরাপদ জীবনপদ্ধতি মেনে চলা, নিরাপদ পানি, খাদ্য নিশ্চিত করা। হেপাটাইটিস সির জন্য এখনো কোনো টিকা পাওয়া না গেলেও জন্মের পর থেকে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত হেপাটাইটিস বি এর প্রতিষেধক তিনটি টিকা নিয়ে সারা জীবনের জন্য হেপাটাইটিস বি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।

আবার বর্তমান যুগে হেপাটাইটিস বি কিংবা সিতে আক্রান্ত হয়ে গেলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করার জন্য, ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য, লিভারকে ভাইরাস থেকে রক্ষা করার জন্য বেশ ভালো ভালো অ্যান্টিভাইরাস ওষুধ পাওয়া যায়। মোটকথা হলো এসব ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে, আক্রান্ত হলে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় রাখতে বা লিভারকে সুস্থ রাখতে চেষ্টার কোনো অবহেলা করা যাবে না। এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ সক্রিয়।

বিশ্বব্যাপী এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিসমুক্ত বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য স্লোগান নিয়ে প্রতিবছর ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সমানতালে এই দিবস পালন করে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘হেপাটাইটিস-ক্যান নট ওয়েট’ মানে আর প্রতীক্ষা নয়, আজই টিকা নিন, এখনই চিকিৎসা শুরু করুন, অন্তঃসত্ত্বা মা কিংবা নবজাতককেও এখনই স্ক্রিনিং করে চিকিৎসা শুরু করুন। এমনকি করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যেও হেপাটাইটিসকে উপেক্ষা করব না। সমাজপতি, বিত্তবান বা রাজনীতিবিদদের কাছে অনুরোধ, আসুন আর অপেক্ষা না করে হেপাটাইটিসের বিষবাষ্প থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য উদ্যোগী হই।

ডা. অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ বাহার হোসেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল