কলিন পাওয়েলকে নিয়ে স্তুতি গাওয়া থামান

কলিন পাওয়েল (বাঁয়ে) ও জর্জ ডব্লিউ বুশ
ছবি: এএফপি

কলিন পাওয়েল মারা গেছেন এবং যথারীতি আমেরিকান মিডিয়া তাঁর প্রশংসাসূচক ধারাভাষ্য আমাদের ওপর বর্ষণ করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলকে নিউইয়র্ক টাইমস ‘পথ প্রদর্শক’ বলে উল্লেখ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার বাকি সংবাদমাধ্যমগুলোও একইভাবে পাওয়েলকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছে। একজন অশ্বেতাঙ্গ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক কাঠামো ভেঙে তিনি কীভাবে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা তারা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে।

২০০১ সালে মার্কিন সিনেট পাওয়েলকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিশ্চিত করার পর তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, সিএনএন তা খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। সেখানে পাওয়েল বলেছিলেন, তাঁর নিয়োগের এই ঘটনা বিশ্বকে দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মডেল সবার জন্য অনুসরণীয়। তিনি বলেছিলেন, কেউ যদি মার্কিন মূল্যবোধে বিশ্বাস রেখে কাজ করে যায়, তাহলে সিনেট তাঁকে নিয়োগ দিয়ে যে ‘অলৌকিক’ ঘটনার সূত্রপাত করেছে, তা অন্যদের জীবনেও ঘটতে পারে।

কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত পশ্চাৎপদ এলাকা হার্লেমে যে লোকটির জন্ম, তরুণ সেনা কর্মকর্তা থাকাকালে নিজের দেশেই নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্ট ও মোটেলে যাঁর গাত্রবর্ণের কারণে ঢোকা নিষেধ ছিল, সেই লোকের এই পর্যায়ে উঠে আসাকে ‘অলৌকিক’ বলা আসলেই অত্যুক্তি হবে না।

এমএসএনবিসি স্তুতিবাক্য বর্ষণে আরও এক ধাপ এগিয়ে থেকে ইউএস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হ্যাসের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরেছে। এন হ্যাস বলেছেন, ‘কলিন পাওয়েল আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সৎ মানুষ।’

যে লোক ২০০৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে টানা ৭৬ মিনিট মিথ্যা বলে গিয়েছিলেন, যে লোক ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার বিষয়ে অসংখ্য মিথ্যা বলে জর্জ বুশ প্রশাসনকে ইরাকে অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে সহায়তা করেছিলেন, সেই লোকের বিষয়ে ‘সৎ’ শব্দটি কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তা বোধগম্য নয়। পাওয়েলকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র না পাওয়ার বাস্তবতা তুলে না ধরা হয়, তাহলে ‘বাস্তবতা’ বলতে আসলে কী বোঝায়, সেটিই অস্পষ্ট থেকে যাবে।

এই মুহূর্তে এসব ঘটনা এড়িয়ে গিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো এমন আচরণ করছে, যা দেখে মনে হচ্ছে এমন একজন মানুষকে তারা মহীয়ান করছে, যিনি সারা বিশ্বে আক্ষরিক অর্থে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করার বিষয়ে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট পাওয়েলের কথা বলতে গিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর দখলদারির কারণে ইরাকের এক লাখের বেশি নাগরিকের নিহত হওয়ার তথ্য চেপে গেছে।

সেই তথ্য তুলে না ধরে তারা ‘ইরাকে কয়েক হাজার মার্কিনের মৃত্যুর’ কথাকে সামনে এনেছে। পত্রিকাটি ইরাক যুদ্ধকে পাওয়েলের রেকর্ডে থাকা একটি ‘দাগ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কিন্তু ইরাক নিয়ে মিথ্যাচার কলিন পাওয়েলের জীবনের একমাত্র ‘দাগ’ নয়। জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের আমলে পাওয়েল জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯১ সালে তাঁর তত্ত্বাবধানেই উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘অপারেশন ডেজার্ট’ নামের একটি কুখ্যাত অভিযান চালানো হয়। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট জেনসেন এই অভিযানকে ‘উপসাগরে চালানো নৃশংস গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

২০০০ সালের মে মাসে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এ জেনসেন তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, এটি ছিল গোটা সমাজের বিরুদ্ধে চালানো একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। কারণ, ওই অভিযানে কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল। জেনসেন বলেছেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ওই বোমা বর্ষণ ছিল সুস্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।

তারও অনেক আগে ১৯৮৯ সালে মধ্য আমেরিকান দেশ পানামায় বোমা হামলাসহ যত ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে, তার সব কটির প্রধান নজরদারি কর্তৃপক্ষের সভাপতি ছিলেন পাওয়েল। সে সময় পাওয়েলের তত্ত্বাবধানে পানামার ক্ষমতাসীন শাসক ও যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের মিত্র মানুয়েল নরিয়েগার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ শীর্ষক অভিযান হয়। এই অভিযানের সময় নরিয়েগার সমর্থক বহু বেসামরিক পানামিয়ানকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

এই অভিযানকে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্-প্রস্তুতির মহড়া হিসেবে মনে করা যেতে পারে। ওই সময় কলিন পাওয়েলের অভিযানসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তাঁদের কাছে খবর আছে, নরিয়েগা মাঝেমধ্যে একটি বাড়িতে যান। সেখানে কোকেনের মজুত আছে। অভিযানে মার্কিন বাহিনী পূর্বঘোষণা অনুযায়ী কোকেন উদ্ধার করল। কিন্তু কয়েক দিন পর জানা গেল, ওগুলো আসলে কোকেন ছিল না। ওটা ছিল কলার পাতায় মোড়ানো তামালেস (পাতায় মোড়ানো রুটি রোলের মতো মেক্সিকান বিশেষ ধরনের খাবার)। এটাও পাওয়েলের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সততা’র আরও এক উদাহরণ।
অথচ কী আশ্চর্য, এই পাওয়েলই গত বছর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যাচারের কড়া সমালোচনা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
বেলেন ফার্নান্দেজ মার্কিন সাময়িকী জ্যাকবিন ম্যাগাজিন-এর সম্পাদক।