কাবুলে ড্রোন হামলার দায় পেন্টাগনকে নিতে হবে

মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত আফগান শিশুছবি: এএফপি

আফগানিস্তানে ড্রোন হামলার দায় পেন্টাগনকে অবশ্যই নিতে হবে। ওই হামলায় জামাইরি আকমদিসহ তাঁর পরিবারের ১০ জন সদস্য নিহত হন। তিনি ১৪ বছর ধরে আফগানিস্তানে উন্নয়নকর্মীর কাজ করতেন। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফেরার পর তাঁর টয়োটো গাড়ির পাশে জড়ো হয়েছিল বাড়ির শিশুরা। সে সময় ড্রোন হামলাটি চালানো হয়। ড্রোন থেকে ছোড়া ‘হেল ফায়ার’ মিসাইল কেন ভুল জায়গায় আঘাত হানল, তা নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা পেন্টাগন দিতে পারেনি।

হামলার ওই ঘটনায় ১৭ সেপ্টেম্বর ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে পেন্টাগন। কিন্তু এর আগে পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউস দাবি করেছিল, ওই হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা আইএসআইএস খোরাসানের সঙ্গে যুক্ত। আমরা এখন জানি, এ দাবি ছিল মিথ্যা। হামলায় এমকিউ-৯ রিপার নামের ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। এ ধরনের ড্রোন অতি সূক্ষ্ম ক্যামেরা, রাডার ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত থাকে।

এই প্রাণঘাতী হামলার সবচেয়ে সমস্যাজনক পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে ড্রোনটি কয়েক ঘণ্টা ধরে একটা সাদা গাড়ি অনুসরণ করেছিল। সেটা আকমদির টয়োটো গাড়ি হতে পারে। একই সময়ে ভিন্ন আরেকটি সাদা গাড়ি আশপাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ওই গাড়িতে আইএস খোরাসানের লোকজন ছিল। ড্রোনটি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, তাঁরা কি গাড়ি চিনতে ভুল করেছিলেন? সেটা হতে পারে। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানেই কেবল সত্যটা বের হতে পারে।

এ ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণের জন্য তিনটি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। প্রথমত, নিউইয়র্ক টাইমস-এর ইভেন হিলের মতে, মার্কিন সেনারা আইএস খোরাসানের পরিচালনা কেন্দ্র হিসেবে একটি ভবন শনাক্ত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভবনটি পুষ্টি ও শিক্ষাবিষয়ক এনজিওর সুপরিচিত ভবন। দ্বিতীয়ত, ড্রোনটির শক্তিশালী নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরক হিসেবে যা শনাক্ত করা হয়েছে, সেটা আসলে পানির পাত্র। তৃতীয়ত, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ড্রোন হামলাটি চালানো হয়েছিল। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সেখানে অবধারিতই ছিল।

পেন্টাগন আরও দাবি করেছিল, গাড়িটাতে ড্রোন হামলার পর দ্বিতীয় আরেকটি বিস্ফোরণ হয়েছিল। এই দাবির পেছনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু পেন্টাগন এখনো স্বীকার করেনি, তাদের এই দাবি মিথ্যা ছিল। ওই তিনটি ব্যাখ্যাহীন ভুলের চেয়েও বাজে ভুল একটা হয়েছে। সেটা হলো ড্রোন হামলাটি তখনই হয়েছে, যখন আকমদির পরিবারের শিশুরা গাড়িটার কাছে ছুটে গিয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। প্রথমত, ড্রোনটি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, সম্ভবত তাঁরা শিশুদের দেখতে পাননি। অথবা শিশুরা যখন আকমদির সঙ্গে কুশল বিনিময় শুরু করেছিল, তার আগেই ড্রোনটি থেকে হেল ফায়ার মিসাইলটি ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁরা শিশুদের দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু আগেই মিসাইলটি ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল। হেল ফায়ার এমন একটা মিসাইল, যেটা ছুড়ে দেওয়ার পর আর কিছু করার থাকে না। ছোড়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এটা লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে যায়।

ড্রোন নিয়ন্ত্রণকারীদের ওপর কিছু হত্যার জন্য শক্ত রাজনৈতিক চাপ থাকতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, তারা সেটাই করেছে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য দায়ী কে, সেটা এখনো জানা যাচ্ছে না। পেন্টাগন মূল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

হেল ফায়ারই প্রথম নয়, এর আগেও মার্কিন মিসাইল ভুল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছিল। সেই হামলায়ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় একটি রেলসেতুতে মার্কিন মিসাইল একটি ট্রেনে গিয়ে আঘাত করেছিল। সেই হামলায় ১০ জন নিহত ও আরও অনেকে হতাহত হয়। মেভেরিক নামের ওই মিসাইল টেলিভিশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ছোড়ার পর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে এটির কয়েক মিনিট সময় লাগত। একই বছরে কসোভোতে ন্যাটো জোটের আরেকটি মেভেরিক মিসাইল একটি সেতুতে বেসামরিক নাগরিকদের বহনকারী বাস উড়িয়ে দিয়েছিল। ওই হামলায় স্কুলের শিক্ষার্থীসহ ২৪ জন নিহত হয়। ন্যাটো বিবৃতিতে ওই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলেছিল।

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলার ঘটনাকে ভুল বলে পেন্টাগন স্বীকার করলেও সেটা কীভাবে ঘটল, তার ব্যাখ্যা তারা দেয়নি। টয়োটো গাড়িটিতে যদি সত্যি সত্যি বোমা থাকত, তাহলে কেন সেটা আগেই ধ্বংস করা হলো না?

মিসাইলটি ছোড়ার সিদ্ধান্ত কারা দিয়েছে, কী প্রমাণের ভিত্তিতে তারা এ হামলা চালাল, পেন্টাগনের কারা এ হামলা চালানোর অনুমতি দিল, সেটা খুঁজে বের করা জরুরি। এটা একটা বেপরোয়া হামলা। ড্রোনটির নিয়ন্ত্রণকারীদের ওপর কিছু হত্যার জন্য শক্ত রাজনৈতিক চাপ থাকতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, তারা সেটাই করেছে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য দায়ী কে, সেটা এখনো জানা যাচ্ছে না। পেন্টাগন মূল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেসকে এ বিষয়ে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি করতে হবে। কীভাবে ও কেন ভুল হলো, সেটা জানার অধিকার জনগণের আছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া

স্টিফেন ব্রায়েন আমেরিকান ফরেন পলিসি কাউন্সিলের প্রতিরক্ষা অধ্যয়নের জ্যেষ্ঠ ফেলো