কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য নিতে আসা সাধারণ মানুষের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

মন্ত্রিসভার সদস্যরা তারস্বরে বলছেন, দেশ শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নাকি বিশ্বের রোল মডেল। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেন, যারা সমালোচক, তারা উন্নয়ন দেখে না বা উন্নয়ন চায় না। তাদের দেশপ্রেম নিয়ে তাঁর সন্দেহ। দেশে অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট—পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল—আরও কত–কী!

খবরের কাগজ খুললেই দেখি অন্য ছবি—নারী অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল, ক্ষমতাবানের দখলে দুর্বলের জমি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে বাজারে নৈরাজ্য, ইউনিয়ন পরিষদ নেতার স্ত্রীর নামে বিধবা ভাতা, ভূমিহীনকে দেওয়া সরকারি বাড়ি বানাতে না বানাতেই ফাটল, খাল-বিলে অ্যাপ্রোচ রোড ছাড়াই কালভার্ট-সেতু, কোথাও কোথাও বিনা মূল্যে প্রাপ্য কোভিডের ভ্যাকসিন বিক্রি—সব মিলিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস।

যিনি ভালো আছেন, তিনি দেখছেন যে দেশ খুব ভালো চলছে। যিনি ভালো নেই, রোল মডেলে তার পেট ভরে না। জিডিপি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি, এই আনন্দে আমরা আটখানা। অর্থশাস্ত্র পড়ার কারণে জিডিপি বিষয়টা আমি কিছুটা বুঝি। যদি বড় দুটি সেতু, তিনটা সেনানিবাস, চারটা মেডিকেল কলেজ বানানো হয়, তাহলে জিডিপি বাড়ে। কিন্তু তাতে মানুষের হাতে টাকা আসে না। অনেকেই ফেসবুকে ট্রল করে লেখেন, এত টাকা মাথাপিছু আয়! কই, আমার হাতে তা নেই কেন! জিডিপি বিষয়টা না বোঝার কারণে এমনটা ভাবে মানুষ। আর মাথাপিছু আয়ের ব্যাপারটা তো পুরোপুরি শুভংকরের ফাঁকি। আপনার আয় ১০০ কোটি টাকা, আমার আয় এক হাজার টাকা। দুজনের আয় যোগ করে দুই দিয়ে ভাগ করলেই তা হয়ে যাবে মাথাপিছু আয়। সে ক্ষেত্রে ভিখারিও কোটিপতি। মন্ত্রীরা কি সবাইকে নির্বোধ মনে করেন?

অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য পরিমাপের জন্য একটি সূচক ব্যবহার করা হয়—জিনি কো-এফিশিয়েন্ট। তো মন্ত্রীরা এর ধারেকাছে দিয়েও যান না, হয়তো এর নামও শোনেননি। এই সূচক দিয়েই বোঝা যায় দেশে আয়বৈষম্য আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। একটা লোককে কোটিপতি বানাতে গেলে পঞ্চাশ-এক শ জনকে গরিবি লাইনের নিচে ঠেলে ফেলতে হয়। টিসিবির ট্রাকের যে ছবিগুলো এখন আমরা দেখি, তা থেকেই বোঝা যায় মানুষের অবস্থা কেমন। এ নিয়েও মন্ত্রীরা-কর্তারা কৌতুক করেন। খাদ্যমন্ত্রী কোথায় লজ্জায় মুখ লুকাবেন তা নয়, তিনি বললেন, অনেকেই এখন চিকন চাল খায় বলে চালের দাম বেড়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে। অনেকেই মনে করেন, সবাই বুঝি তাঁর মতোই।

আরও পড়ুন

ঢাকা-চট্টগ্রামের যানজটের কথা মনে হলেই গা শিউরে ওঠে। মেট্রোরেলের দোহাই দিয়ে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে রাখা হচ্ছে। যাঁরা রীতিমতো কারফিউ দিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে যাতায়াত করেন, তাঁরা এটা বুঝবেন না। ঢাকা এখন বসবাসের অচল একটি শহর। ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরী। তো আমরা রোল মডেল হই কীভাবে?

আমরা যখন পরাধীন ছিলাম, তখন আয়বৈষম্য এত বেশি ছিল না। তখন মানুষ গরিব ছিল। তখন ব্যবসায়ীরা ছিল ধনী। কিন্তু লুটেরার সংখ্যা ছিল কম। ব্যবসায়ীর সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। লুটেরাদের সংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। সত্তর দশকের শুরুর দিকে, যখন মন খুলে পত্রিকায় লেখালেখি করা যেত, তখন এই লুটেরাদের পরিচিতি হয়েছিল ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এরা লুম্পেনই রয়ে গেছে। খাসলত বদলায়নি। এরা অনেকেই ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে স্ফীত হচ্ছে। এদের যত মোটাতাজাকরণ চলছে, ততই মানুষ বেশি সংখ্যায় দারিদ্র্যরেখার নিচে নেমে যাচ্ছে।

একটু আগে প্রিয় কবি সোহরাব হাসানের সদ্যোজাত কবিতা সংকলনটি দেখছিলাম। তিনি নিজেই গতকাল রোববার সকালে উপহার দিয়ে গেলেন তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’। সেখানে একটি কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম:

কারো দুঃসময় মানে

কারো জন্যে দারুণ সুসময়

কারো হাত খালি থাকা মানে

কারো হাতে অতিরিক্ত পুঁজি।

কমবখত লোক আমি

তাই আপনাদের এই অসম বণ্টনের

ব্যাপারটা একদম কম বুঝি।

একটা লোককে কোটিপতি বানাতে গেলে পঞ্চাশ-এক শ জনকে গরিবি লাইনের নিচে ঠেলে ফেলতে হয়। টিসিবির ট্রাকের যে ছবিগুলো এখন আমরা দেখি, তা থেকেই বোঝা যায় মানুষের অবস্থা কেমন। এ নিয়েও মন্ত্রীরা-কর্তারা কৌতুক করেন। খাদ্যমন্ত্রী কোথায় লজ্জায় মুখ লুকাবেন তা নয়, তিনি বললেন, অনেকেই এখন চিকন চাল খায় বলে চালের দাম বেড়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে। অনেকেই মনে করেন, সবাই বুঝি তাঁর মতোই।

এ লাইনগুলো পড়তে পড়তে ছোটবেলা থেকে শুনে আসা একটি বচনের কথা মনে পড়ল—কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ। কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশের মূল্যে আমাদের যে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, তার উপকারভোগী হচ্ছে গুটিকয় পরিবার ও চক্র। আমরা তাদের নাম জানি, তাদের অনেককে চিনি। দশ-বিশ বছর আগে যে মলিন পোশাকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে ঢাকায় এসেছিল, ঠিকমতো রাস্তা পার হতে পারত না, সে আজ আলাদিনের চেরাগের বদৌলতে হাজার কোটি টাকার মালিক। কোটি সংখ্যায় কয়টা শূন্য লাগে, আমি তা চটজলদি বলতে পারব না। পত্রিকায় চুরিচামারির যেসব কেচ্ছা পড়ি, তার কোনোটাই এখন হাজার কোটির কম নয়। তারপরও উন্নয়নের ঢাক পেটানো হচ্ছে। এদের কথা শুনলে গোয়েবলসও লজ্জা পেতেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন—বলেন তো ভাই, এই গোয়েবলসটা কে? তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলছি, হিটলারের তথ্যমন্ত্রীর নাম ছিল গোয়েবলস।

লেখাটি শেষ করব আজকের সংবাদপত্রের কয়েকটি শিরোনাম দিয়ে। পত্রিকার খবরগুলোও এখন সমাজের আয়না। আমি যে পত্রিকা নিয়মিত পড়ি, তার প্রথম পাতার প্রধান সংবাদের ওপর টিসিবির ট্রাকের সামনে ভিড় করা নারীদের বাড়ানো হাত। সংবাদের শিরোনাম—অপেক্ষার পরও কেন খালি হাতে ফেরা। এর নিচেই তিনটি উপশিরোনাম—মোহাম্মদপুর: রাস্তায় কেনে পুলিশ, লাইন ছাড়াই নেন কাউন্সিলরের লোক; দয়াগঞ্জ ও রূপনগর: চার ঘণ্টা অপেক্ষা, তবু ফিরতে হলো খালি হাতে; হাতিরঝিল: পুলিশের গাড়িতে পণ্য ওঠানোর ছবি তোলায় হেনস্তা।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয় পাতার প্রধান সংবাদ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে দুই কলাম বক্তব্য: গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকায় আজ বাংলাদেশের এই উন্নয়ন। খবরটির দুটি অর্থ। এক. দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, দুই. গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। পাশেই এক কলামে জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সরকারি দলের পার্টনার জি এম কাদেরের আক্ষেপ—কেবল সরকারি দলের লোকেরাই ভালো আছেন। এর বেশি উদাহরণ আপাতত আর দিতে চাই না। আমরা বেশ আছি!

তারপরও আমরা ভালো আছি, এ কথা বলার লোকের অভাব নেই। আগে একজন মোনেম খান ছিলেন। এখন মোনেম খানের সংখ্যা অসংখ্য। মোনেম খানরা সমাজে কোনো সমস্যা দেখেন না। তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষের জুজু দেখেন অহরহ। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে অমার্জিত ভাষা ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন পাকিস্তানের প্রথম উজিরে আজম লিয়াকত আলী খান, পরবর্তী শাসকেরা এখন পর্যন্ত একই ভাষা ব্যবহার করে চলেছেন। তাঁরা চোখে তাঁদের সমালোচক ছাড়া আর কোনো সমস্যা দেখেন না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]