কার ওপর ভরসা করব? পুতিন, বাইডেন নাকি গোগল

নিকোলাই গোগল

আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যখন বৈশ্বিক দুর্যোগের খবর আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি যখন পুরোমাত্রায় বিশ্বকে আঘাত করছিল, সেই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার সময় আমাদের ভাবতে হচ্ছিল আমরা কী করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের মতো বিপর্যয় থেকে বাঁচতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয় এখন ভয়াবহ চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। এসব দুর্যোগ ও করোনাজনিত মহামারি লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলছে।

আমাদের জলবায়ু সংকটকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরে অ্যাডাম ম্যাককের অ্যাপোক্যালিপ্টিক ব্ল্যাক কমেডি ডোন্ট লুক আপ (২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) সিনেমাটি দেখছিলাম। ক্ষমতাধরেরা বৈশ্বিক এবং মানবিক স্বার্থকে পাত্তা না দিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কীভাবে গণবিধ্বংসী কাজ করছে, তা ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ ছবিতে। ছবিটিতে তুলে ধরা বিপর্যয়ের আলোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমে আচমকা ভয়ংকর সব শিরোনাম উঠল। সে সব খবর থেকে জানলাম, ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করতে চলেছেন।

বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, ঠিক ওই সময়টাতেই এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা ওরিয়েন্টালিজম বইটির রুশ অনুবাদগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের জন্য আমাকে মস্কোয় দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে আমি সেখানে যেতে পারিনি। ভাগ্যিস যেতে পারিনি। আমি যদি মস্কো যেতাম, তাহলে নিশ্চিত সেখানে আটকা পড়তাম। কারণ, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার কারণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সব ধরনের বিমানকে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু এর শেষ কোথায়? জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট যখন বিশ্বকে মহা বিপাকে ফেলছে, যখন একটা বৈশ্বিক মহামারি চলছে, আফগানিস্তান ও ইয়েমেন থেকে ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে যখন লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে; ক্ষুধা, মৃত্যু, ধ্বংসলীলায় পৃথিবীর যখন টালমাটাল অবস্থা, তখন রাশিয়ার এ যুদ্ধ বিশ্বের জন্য কী বয়ে আনতে পারে? এ অবস্থায় আমরা কী করে সর্বত্র ছেয়ে যাওয়া ধোঁয়ার মধ্য থেকে মাথা উঁচু করে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার আশা করতে পারি?

যখন আমার মনে হতে থাকে পৃথিবী একেবারে লাগামছাড়া হয়ে মহা ধ্বংসের দিকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে, তখন আমি চিত্রকর্ম, বিশ্বসাহিত্য ও সংগীতের মাস্টারপিসগুলোকে আশ্রয় মেনে তাতে বুঁদ হয়ে যাই। যখন তুমুল অসহায় হয়ে পড়ি তখন সাধারণত আমি শোস্তাকোভিচ (রাশিয়ার বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার দিমিত্রি শোস্তাকোভিচ) ও বাখের (জার্মানির বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার সেবাস্তিয়ান বাখ) মিউজিকে কান পাতি। অথবা গোগল (রুশ নাট্যকার নিকোলাই গোগল) এবং হাফিজের (পারস্যের কিংবদন্তি কবি হাফিজ) লেখা পড়ি কিংবা এল গ্রেকো (গ্রিক চিত্রশিল্পী) এবং বেহজাদের (পারস্যের চিত্রশিল্পী কামাল উদ্দিন বেহজাদ) শিল্পকর্মের ওপর নজর বোলাতে থাকি। অথবা আমার বিছানার পাশে রাখা বহুল পাঠে ছিন্নপ্রায় ইনভেনশন অব আফ্রিকা (এই বইটির লেখক কঙ্গোর বংশোদ্ভূত ফরাসি দার্শনিক ওয়াই ভি মুদিমবে) এবং ট্রুথ অ্যান্ড মেথড (এই বইটির লেখক জার্মান দার্শনিক হান্স জর্জ গাদামার) বইটিতে ডুবে যাই।

আজ এ উন্মত্ত বিশ্বের উত্তেজনা থেকে নিজের আত্মাকে ঠান্ডা রাখতে এসব শিল্পের মধ্যে ডুবে না থেকে উপায় নেই। দুই সপ্তাহ ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রচারযুদ্ধ যেন উন্মাদনার পর্যায়ে চলে গেছে। ট্রাম্প-সমর্থক দক্ষিণপন্থীরা পুতিনের প্রশংসা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যাসগত উদারপন্থীদের রুশবিদ্বেষ আরও বেড়ে গেছে। ফক্স নিউজের টুকার কার্লসন রাশিয়ার অভিযানকে সমর্থন দিয়ে এবং পুতিনের প্রশংসা করে রাশিয়াবিদ্বেষীদের তোপের মুখে পড়েছেন। অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমস পুতিন-সমর্থক শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট যখন বিশ্বকে মহা বিপাকে ফেলছে, যখন একটা বৈশ্বিক মহামারি চলছে, আফগানিস্তান ও ইয়েমেন থেকে ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে যখন লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে; ক্ষুধা, মৃত্যু, ধ্বংসলীলায় পৃথিবীর যখন টালমাটাল অবস্থা, তখন ইউক্রেনে রাশিয়ার এ যুদ্ধ বিশ্বের জন্য কী বয়ে আনতে পারে? এ অবস্থায় আমরা কী করে সর্বত্র ছেয়ে যাওয়া ধোঁয়ার মধ্য থেকে মাথা উঁচু করে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার আশা করতে পারি?

এ অবস্থায় বহুলবিশ্রুত সেই বাগ্‌ধারাকেই আমাদের অনুসরণ করতে হয়, ‘প্লেগ অন বোথ ইয়োর হাইজেস’ (ভাবার্থ: তোমরা দুজনই প্লেগ আক্রান্তের মতো, আমি তোমাদের কারও সঙ্গে নেই)। ইউক্রেন, আফগানিস্তান, ইরাক বা ইয়েমেনের নিরপরাধ মানুষকে কেন সাম্রাজ্যবাদী পতাকার দাম্ভিকতার মূল্য দিতে হবে? আমি আমার কৈশোরে রুশ এবং আমেরিকান সাহিত্যে ডুবেছিলাম। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। রাশিয়ান সাহিত্যের প্রতি আমার মুগ্ধতা যিনি বহুগুণ বাড়িয়েছিলেন, সেই বিশাল আলোকিত ব্যক্তিদের একজন হলেন ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগল। তাঁর ডেড সোলস-এর ফারসি অনুবাদ পড়ে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা জন্মে। আমি তঁার প্রতি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে আমি তার একটি মাস্টারপিস ফারসিতে অনুবাদ করেছিলাম।

গোগল যে আসলে জন্মসূত্রে ইউক্রেনীয়, কিন্তু সাহিত্য–সংস্কৃতিতে রাশিয়ান, সে কথা দীর্ঘদিন পর আমি জেনেছিলাম। যখনই আমি বাইডেন এবং পুতিনকে তাঁদের নিজ নিজ শ্রোতাদের ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে দেখছি, তখনই গোগলের কথা মনে পড়ছে। আমি যখন বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দুই প্রেসিডেন্টের কামড়াকামড়ি দেখছি, তখন এটি না ভেবে থাকতে পারছি না যে এ দুজনের কথায় মনোযোগ না দিয়ে যদি আমরা এ অঞ্চলের সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে মন দিতাম, তাহলে এখানকার মানচিত্রের একটি ভিন্ন চেহারা দেখতে পেতাম।

আরও পড়ুন

গোগলের ঐতিহাসিক উপন্যাস তারাস বুলবার কথাই ধরুন। এটি একটি মহাকাব্যিক নভেলা, যা কোসাক (পূর্ব ইউরোপের গণতন্ত্রপন্থী অর্থোডক্স খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যাঁদের আধুনিক ইউক্রেনের পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। তাতারদের হামলা ঠেকাতে পোল্যান্ড ও রাশিয়ার সরকারগুলো কোসাক মিলিশিয়াদের ভাড়া করত) যোদ্ধাদের জীবনকে বর্ণনা করেছে। ১৯৪২ সালে গোগল এ উপন্যাসের একটি পরিমার্জিত সংস্করণ বের করেন, যাতে রাশিয়ান জাতীয়তাবাদী বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলা হয়, এই দ্বিতীয় সংস্করণটি আসলে ‘একটি ইউক্রেনীয় গল্পের একটি রাশিয়ান উপন্যাসে রূপান্তর’ যা কোসাক এবং রাশিয়ান আত্মার সম্মিলনকেই নির্দেশ করে।

গোগল জন্মেছিলেন ইউক্রেনে, লিখতেন রুশ ভাষায়, আর তাঁর লেখা পঠিত হয় গোটা বিশ্বে। তাঁর লেখায় বারবার ইউক্রেনের প্রতি তাঁর মমত্বের সুর বেজে উঠতে দেখা যায়। তিনি যখন ২০ বছর বয়সে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় চলে আসেন, তখন তিনি তাঁর জন্মভূমির উপহার সাহিত্যের একটি প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডে নিয়ে আসেন। তিনি তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি এবং তুর্গেনেভের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, রাশিয়ান সাহিত্যকে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী পদে স্থাপন করেছিলেন। গোগল রাশিয়ার রাজতন্ত্রকে ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু তার জন্য কোনো রাশিয়ান গুন্ডা কি কখনো গোগলকে বলেছিল, ‘তুমি যেখান থেকে এসেছ, সেখানে চলে যাও?’ অথচ আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গুন্ডারা এ দেশে অন্যদের নিয়মিত এ কথা বলে থাকে। বরং গোগলের সঙ্গে উল্টোটা হয়েছে।

২০০৯ সালে একটি প্রবন্ধে রুশ সাংবাদিক টম পারফিত রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং গোগোলকে নিজেদের বলে দাবি করেছিলেন। টম পারফিত বলেছেন, ‘রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বৈরিতা প্রথমে ছিল রাজনীতি নিয়ে, তারপর গ্যাস নিয়ে আর এখন গোগল নিয়ে। বিবদমান প্রতিবেশীরা গোগলের ২০০তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর উত্তরাধিকারের জন্য লড়াই করছে।’ রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারযন্ত্রে কান না দিয়ে রাশিয়ান সাহিত্যের একজন ইউক্রেনীয় মহাত্মা গোগলের দিকে ফিরে যাওয়াই বিশ্বের জন্য ভালো হবে। তার উচ্চতর সাহিত্যের মধ্যে সভ্যতা ও বর্বরতার যে সীমা নির্দেশ করেছেন, সেদিকেই সবার মন দেওয়া উচিত।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

হামিদ দাবাশি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক