কার নেতৃত্বে কখন ‘জাতীয় সরকার’

বাংলাদেশে যেকোনো রাজনৈতিক সংকটকালে ‘জাতীয় সরকার’ নিয়ে সরগরম আলোচনা হয়। জাতীয় সরকারের দাবি তখনই সামনে আসে, যখন দলীয় সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। যেমন গ্রেট ব্রিটেনে র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে ১৯৩১-৩৫ সালের মেয়াদে এ রকম একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। বর্ণবাদী ব্যবস্থা বিলোপের পর দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা যে সরকার গঠন করেছিলেন, তাকেও জাতীয় সরকার বলা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সংকটটা হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখনো নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেনি। কয়েকটি দল মিলে সরকার হলেই সেটি জাতীয় হয় না। সরকারের বাইরে যারা থাকে, তারাও জাতির অংশীদার।

বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সরকারের ধারণাটি আসে ১৯৭১ সালে। সে সময় আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের দাবি ছিল সব দলকে নিয়েই সরকার গঠন করা হোক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেই দাবি মেনে নেয়নি, তারা এককভাবে সরকার গঠন করে।

স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের প্রথম দাবি উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। আওয়ামী লীগ সে দাবি গ্রাহ্য করেনি। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাবটা ছিল, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আমরাই দেশ শাসন করব। অন্যেরা নাক গলাবে কেন?’ কিন্তু যখন দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে থাকে, জাতীয় সংসদে ২৯৩টি আসন নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন। একদলীয় সরকারকেই জাতীয় বলে চালানো হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জাসদ নেতা কর্নেল (অব.) আবু তাহের আওয়ামী লীগবিরোধী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেটি কার্যকর হওয়ার আগেই ক্ষমতা চলে যায় জিয়াউর রহমানের হাতে। জিয়া ও তাঁর উত্তরসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উর্দি পরা অথবা উর্দি খোলা অবস্থায় যে সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাতে সব দল থেকে নেতা ভাগিয়ে এনে ‘জাতীয়’ চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলেও বিএনপির দুই সাংসদকে ভাগিয়ে মন্ত্রী করে ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠন করা হলো।

সম্প্রতি বিএনপি আরেকটি জাতীয় সরকারের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে; যার মূল কথা হলো: নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে (জয়ী বা পরাজিত) জাতীয় সরকার গঠন করা হবে (সূত্র: ৩০ মার্চ বিএনপির সংবাদ সম্মেলন)। মিত্র ও সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিএনপির নেতারা এ প্রস্তাব দেননি। প্রস্তাব দিয়েছেন লন্ডনে থাকা দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বেশ কিছুদিন আগে থেকে বিএনপি ২০–দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বাইরের বেশ কিছু দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। উদ্দেশ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে জোরদার আন্দোলন করা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন প্রশ্নে অনেকের মধ্যেই দ্বিধা আছে। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনেরও বিরোধী তারা। কোনো কোনো বাম দল মনে করে, আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনলে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। মুষ্টিমেয় ধনীর স্বার্থে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে, তার পরিবর্তন প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে বামদের ডাকা হরতালে বিএনপির নৈতিক সমর্থনের জবাবে একজন বাম নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা তো বিএনপির সমর্থন চাইনি, আমরা আমাদের শক্তিতেই হরতাল করছি।’

নির্বাচনের দেখা নেই, আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি নেই আর বিএনপির নেতারা জাতীয় সরকারের টোপ দিচ্ছেন। বিএনপির ঘোষণায় নতুন কিছু নেই। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ১৪ দল গঠন করা হয়েছিল, তাদেরও মূল কথা ছিল একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং একসঙ্গে সরকার গঠন। তারা আন্দোলন করে সফল হয়েছিল বলেই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।

এর আগে বিতর্ক ছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনটি দলীয় সরকারের অধীনে হবে, না নির্দলীয় বা জাতীয় সরকারের অধীনে হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও জেএসডি নেতা আ স ম আবদুর রব দাবি করে আসছিলেন জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়েও তিন মত আছে। প্রথম মতের প্রবক্তারা বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারে, যাতে বিএনপিসহ সব দলের প্রতিনিধি থাকবেন। এটি ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রস্তাবের অনুরূপ। সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রাজপথে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের হুমকি ও আন্দোলনের মুখে। এবার সেই ধরনের আন্দোলন নেই। তারপরও আওয়ামী লীগ পুরোনো প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে পারে রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে। দ্বিতীয় মত হলো আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হবে এবং সেই সরকার কমপক্ষে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করবে। এ ধারণা ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের কাছাকাছি। আর তৃতীয় মতটি হলো আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে নির্দলীয় সরকার গঠন করা হবে এবং তারা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিএনপির জাতীয় সরকারের এ প্রস্তাবকে অনেকটা ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুঁতে দেওয়া’ কিংবা ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। জাতীয় সরকার গঠন অনেক দূরের বিষয়। তার আগে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের দেখা নেই, আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি নেই আর বিএনপির নেতারা জাতীয় সরকারের টোপ দিচ্ছেন। বিএনপির ঘোষণায় নতুন কিছু নেই। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ১৪ দল গঠন করা হয়েছিল, তাদেরও মূল কথা ছিল একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং একসঙ্গে সরকার গঠন। তারা আন্দোলন করে সফল হয়েছিল বলেই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনটি বাতিল হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

২০০৬ সালে কেবল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল নয়, রাষ্ট্রের প্রায় সব শক্তি ও সংগঠন বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলেরও সমর্থন হারিয়েছিল তারা। এখন কি দেশে সে রকম কোনো পরিস্থিতি বিরাজ করছে? জাতীয় নির্বাচনের বাকি পৌনে দুই বছর। এ মুহূর্তে নির্বাচনের পরের কথা না ভেবে নির্বাচনটি কীভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করা যায়, সেই বিষয়েই সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার বলে মনে করি। আগের ধাপগুলো পার না হয়ে বিএনপির নির্বাচন–পরবর্তী জাতীয় সরকারের ঘোষণা কোনো ফল দেবে না। এতে সরকারের বাইরে থাকা ছোট দলগুলো উৎসাহিত হতে পারে, দেশবাসী ভরসা পাবে বলে মনে হয় না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]