
‘আব্বা পেট্রলপাম্পে চাকরি করত, আমি বড় বইনের লগে ইন্টারকনের গেটে ফুল বেচতাম। তারপরে পেপার বেচা আরম্ভ করলাম। সকালে পেপার বেচতাম, বৈকালে ফুল।’ সত্তর দশকের গল্প বলছিলেন কালু মিয়া। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গেটে ও আশপাশের রাস্তায় ফুল আর খবরের কাগজ বিক্রি করতে করতে তাঁর কৈশোর পেরিয়ে যায়; স্কুলে যাওয়া হয় না, এক হরফ বিদ্যাও তাঁর ঘটে নাই।
তবু তরুণ বয়সে তিনি আবিষ্কার করেন, ‘ফরেনার’দের সঙ্গে টুকটাক ‘টকিং’ করতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে না। ফরেনাররা তাঁকে ডেকে বলে, ‘আই গো ওল্ড টাউন, ইউ হেল্প মি?’
‘আমি কই, হোয়াইট নট? শিওর আই হেল্প ইউ।’
কালু মিয়া ফুল-পেপারের ফেরিওয়ালা থেকে বিদেশি পর্যটকদের ‘এসকট কাম ইন্টারপ্রিয়েটার’ হয়ে ওঠার গল্প বলতে
শুরু করেন:
‘ফরেনারগো লইয়া হোসেনি দালান যাই, বলধা গার্ডেন যাই, লালবাগ কেল্লায় যাই। কেউ কেউ ঘোড়ার গাড়ি দেইখ্যা কয়, চড়ব। আমি কই নো প্রবলেম। রংচঙা ঘোড়ার গাড়িতে উঠায়া ওল্ড টাউনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরাই। সদরঘাট যাই, নদী আর নৌকা দেইখ্যা কয়, নৌকায় ভি চড়ব, বুড়িগঙ্গার হাওয়া খাইব। আমি কই নো প্রবলেম। তখন বুড়িগঙ্গার পানি এমুন গান্দা আছিল না, স্যার। নদীর হাওয়া আছিল সত্যই খাওয়ার মতন...।’
সব দাঁত বের করে হাসেন কালু মিয়া। কিন্তু সব দাঁত তাঁর নাই, ওপরের পাটির সামনের তিনটা উধাও। অবশিষ্টগুলোর স্বাভাবিক রং ঢাকা পড়েছে পান-জর্দার কষে। বদনের মিশকালো রং তাঁর নামের সার্থকতা জাহির করে। থুতনি-চোয়াল ঢেকে আছে অযত্নে বেড়ে ওঠা কাঁচা–পাকা দাড়িতে, তবে মোচ কাঁচি দিয়ে সযত্নে ছাঁটা। মাথার সঙ্গে সেঁটে রয়েছে ঘন নীল রঙের একটা গোল টুপি। পরনের ফুলহাতা শার্টখানার রং এককালে আকাশি নীল ছিল বলে মনে হয়; ঢিলেঢালা প্যান্ট এতই মলিন যে তার রং ঘন নীল না গাঢ় খয়েরি, ঠিক ঠাওর করা যায় না। এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে নজর কাড়ে তাঁর দুটি চোখের দৃষ্টি: যেন জীবনের সব প্রহেলিকা ফুটে আছে ওই দুটি চোখে।
জানতে চাই, বিদেশিদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে রোজগার কেমন হতো।
‘দিন শ্যাষে হেরা কইত, টেল মি হাউ মাচ আই গিভ ইউ। আমি কইতাম, নো স্যার, নো ম্যাডাম, আই নো টেল। গিভ মি অ্যাজ ইউ লাইক, ইউর উইশ।’
‘তারপর? তারা কেমন দিত? দিনে কত রোজগার হতো আপনার?’
‘ভালো স্যার, এনাফ। আমার দিন চইল্যা যাইত।’
‘এক দিনে সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছেন কত? মনে আছে?’
‘কোনো কোনো ফরেনার খুশি হইয়া পাঁচ হাজারও দিছে। কেউ সাইকেল কিন্যা দিবার চাইছে, আমি লই নাই।’
একপর্যায়ে কয়েকটি এয়ারলাইনের পাইলট ও কেবিন ক্রুর সদস্যদের সঙ্গে কালু মিয়ার সখ্য গড়ে ওঠে। এর ফলে তাঁর অনিশ্চয়তা দূর হয়। তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক পাইলটের কথা ঘুরেফিরেই বলেন, যিনি তাঁকে ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ‘মিস্টার উডফোর্ড গ্রে, আমারে কইছিল, আই টেক ইউ মিলফোর্ড, ইউ টেক কেয়ার মাই কান্ট্রি হাউস, ইউ কাট গ্র্যাস ইন মাই লন...কিন্তু ব্রিটিশ এমবাসি আমারে ভিসা দেয় নাই।’
ইন্টারকন্টিনেন্টাল যখন শেরাটন হলো, তত দিনে কালু মিয়া অন্তত ১০টা ভাষায় ‘ইন্টারপ্রিয়েটারি’ করার দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন। মোবাইল ফোন চালু হলে হোটেলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকার দিন শেষ হয়। ভোররাতে তাঁর বালিশের পাশে বেজে ওঠে মোবাইল ফোন, ‘মিস্টার আবদুল কালু, আয়্যাম ইন প্যান প্যাসিফিক...।’
এভাবে দিনগুলো কাটছিল ভালোই। যদিও সংসারে অশান্তি; বড় ছেলেটা ছন্নছাড়া, বিয়ে করেছিল, দুটো বাচ্চাও হয়েছে।
কিন্তু ছন্নছাড়া বলে বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে, সে-ও উধাও। দুই নাতি এখন দাদা-দাদির সংসারে। ছোট ছেলেটা নেশাগ্রস্ত, বিয়ে করেছে এক নেশাগ্রস্ত মেয়েকে। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, থাকে মগবাজারের মধুবাজার না কোথায়; নিজেরা নেশা খায়, নেশা কেনাবেচা করে।
কালু মিয়ার মেয়ে তিনটা। বিয়ে দিয়েছেন। দুই মেয়ে স্বামীর সংসারে ভালোই আছে; কিন্তু ছোটটার বাচ্চা হয় না বলে বিয়ে টেকে না। দুটো বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর কালু মিয়া এই মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন সৌদি আরবের দাম্মাম শহরে, বাসাবাড়িতে কাজ করতে। এই মেয়েই এখন তাঁর একমাত্র সহায়।
কারণ, এখন আর ভোররাতে তাঁর বালিশের পাশে বেজে ওঠে না মোবাইল ফোন।
‘দুর্দিন আরম্ভ হইছে ৫ জানুয়ারির ইলেকশনের টাইমে। তারপর থিকা ফরেনারগো আসা কইম্যা গেছে। আর এক্করে সব্বনাশ হইছে স্যার, গুলশান হলি আর্টিজান ম্যাসাকারে। এক্করে ম্যাসাকার কইর্যালাইছে। ফরেনার আসা এমুনই কমার কমছে, কী আর কমু। সামান্য কিছু আইলেও হেরা আর আগের মতন ঘোরাঘুরি করে না, দরকারি কামকাজ সাইর্যা জলদি জলদি চইল্যা যায়। আয়্যাম নো নিড, স্যার! নাউ অ্যায়াম নো নিড টু দেম।’
এই দুর্দিনে কালু মিয়ার একমাত্র সহায় তাঁর ওই বাঁজা মেয়েটি; দাম্মাম থেকে সে মাসে মাসে ‘সামান্য কিছু’ পাঠায় বলেই বউ আর ছোট ছোট দুই নাতিকে নিয়ে তাঁর দিন কোনোমতে চলে যাচ্ছে।
‘দ্যাশের অবস্থা কি আর ভালো হইব না, স্যার?’ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ৫৬ বছর বয়সী কালু মিয়া, যিনি নতুন করে কোনো পেশা বেছে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। আমি উত্তর না দিয়ে উল্টো তাঁকেই জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনার কী মনে হয়?’
‘কইতে পারি না, স্যার। কিন্তু দুর্দিন তো চিরকাল থাকে না। এইডা তো নিয়ম না। আমি ফজরের টাইমে ডিরিম দেখি, আমার বালিশের পাশে মোবাইল বাজতাছে।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
[email protected]