কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিযোগিতামূলক র‍্যাঙ্কিং দরকার

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে একজন সহকর্মী বাংলাদেশি ছাত্র আমার কাছে একটি প্রতিবেদন নিয়ে এসেছিলেন, যেখানে অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি বাংলাদেশ থেকে তাঁর বিএসসি ডিগ্রি অ্যাসোসিয়েট ডিপ্লোমা হিসেবে মূল্যায়ন করেছে এবং তাঁকে সেখানে বিএসসি বা সমমান সম্পন্ন করার জন্য আরও একটি বছর অধ্যয়ন করার পরামর্শ দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমি ভেবেছিলাম যে এটি একটি ভুল। কিন্তু ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ইঞ্জিনিয়ার্স অস্ট্রেলিয়া, ভেটএসেস, এসিএস–এর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একই রকম মূল্যায়ন পেয়েছিলেন।

সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্তরাও ছিলেন। বিভিন্ন উন্নত দেশে ইতিমধ্যে এ ধরনের ঘটনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, ভবিষ্যতেও যে ঘটবে, তা সহজেই অনুমেয়।

এটা উদ্বেগজনক, কিন্তু আশ্চর্যজনক নয়! বৈশ্বিক–বাণিজ্যিক বিশ্বে শিক্ষা আর শুধু সেবা নয়, বরং একটি ব্যবসাও। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য একই দর্শন বহন করে—মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ৪১ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছে এবং মোট ২ লাখ ৬০ হাজার পূর্ণকালীন চাকরির জোগান দিয়েছে।

উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ার ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার শিক্ষার্থী তাঁদের ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন এবং র‌্যাঙ্কিং তাঁদের সাফল্যগাথায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২০২১ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বেশির ভাগ উন্নত দেশই ‘স্টাডি ইন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা আমেরিকা’ নামে শিক্ষা মেলার আয়োজন করছে। ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশে আমরা কি আশা করতে পারি না যে আমাদের অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় টাইমস, কিউএস বা কোনো নামকরা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ৩০০ থেকে ৫০০–এর মধ্যে স্থান পাবে? ভারত ইতিমধ্যেই ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা বা আরব অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে আমাদের পরিকল্পনা কী, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং এবং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানসম্পন্ন শিক্ষার গুরুত্বকে অনুধাবন করে দেশের প্রথম বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সূচনা করেছিলেন, এরই ধারাবাহিকতায় ইউজিসি ১৯৭৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ইউজিসির ৫০ বছর পূর্তিতে ‘বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল র‍্যাঙ্কিং অব ইউনিভার্সিটিজ ইন বাংলাদেশ’ বৈশ্বিক ট্রান্সন্যাশনাল শিক্ষা ইকোসিস্টেমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত হয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, কোভিড-১৯–এর বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। করদাতার আয় এবং সমাজের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সরকার এখন উচ্চশিক্ষা ঋণ কর্মসূচি চালু করতে পারে, যেমন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে, সরকারি-ভর্তুকিপ্রাপ্ত এবং সম্পূর্ণ ফি প্রদান স্কিম। ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করার জন্য টিউশন ফি এবং সুযোগ-সুবিধাগুলো নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা আমাদের কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই প্রবণতা আমাদের দেশ থেকে বার্ষিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অধিক রেমিট্যান্স প্রবাহের বহির্গমন বন্ধ করতে সাহায্য করবে।

টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিং সূচক এবং সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবদানের শতাংশ হলো: ১. পাঠদান (৩০), ২. গবেষণা (৩০), ৩. সাইটেশন বা উদ্ধৃতি (৩০), ৪. আন্তর্জাতিক আউটলুক (৭.৫) এবং ৫. শিল্প আয় (২.৫)। পাঠদানে (শিক্ষার পরিবেশ), খ্যাতি সমীক্ষা: ১৫ শতাংশ, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত: ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ডক্টরেট থেকে স্নাতক অনুপাত: ২ দশমিক ২৫ শতাংশ, ডক্টরেট-শিক্ষক অনুপাত: ৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক আয়: ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। গবেষণায় (আকার, আয় ও খ্যাতি), খ্যাতি জরিপ: ১৮ শতাংশ, গবেষণা আয়: ৬ শতাংশ, গবেষণা উৎপাদনশীলতা: ৬ শতাংশ।

সাইটেশন (গবেষণার প্রভাব), নতুন জ্ঞান এবং ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধগুলো গড়ে কতবার উদ্ধৃত হয়েছে, তার দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে (শিক্ষক, ছাত্র, গবেষণা), আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপাত: ২ দশমিক ৫ শতাংশ, আন্তর্জাতিক শিক্ষকদের অনুপাত: ২ দশমিক ৫ শতাংশ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সব শেষে শিল্প আয় (জ্ঞান স্থানান্তর), শিল্পকে সাহায্য করার জন্য উদ্ভাবন এবং পরামর্শের মাধ্যমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিল্প থেকে কত গবেষণা বাবদ আয় করে, তা একাডেমিক কর্মীদের সংখ্যার বিপরীতে ট্যালি করে দেখা হয়।

কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে সূচক এবং সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবদানের শতাংশ হলো: ১. একাডেমিক খ্যাতি (৪০), ২. নিয়োগকর্তার খ্যাতি (১০), ৩. শিক্ষক–ছাত্র অনুপাত (২০), ৪. শিক্ষকপ্রতি উদ্ধৃতি (২০), ৫. আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত (৫) এবং ৬. আন্তর্জাতিক ছাত্র অনুপাত (৫)। প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক রেপুটেশন স্কোর একাডেমিক সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, যা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষাদান এবং গবেষণার মান–সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞদের মতামতকে একত্র করে। নিয়োগকর্তার খ্যাতি নিয়োগকর্তা সমীক্ষার ওপর নির্ভর করে, যা তাদের সেসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে বলে, যেখান থেকে তারা সবচেয়ে যোগ্য, উদ্ভাবনী, কার্যকর স্নাতকদের নিয়োগ দেয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক–ছাত্র অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক বা আন্তর্জাতিক ছাত্র অনুপাত টাইমস উচ্চশিক্ষা র‌্যাঙ্কিংয়ের অনুরূপ আক্ষরিক অর্থ বহন করে।

এখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে এবং তাদের প্রচুরসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে আমাদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে এবং খুব কমসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও সহযোগিতা বিদ্যমান। আমাদের অবশ্যই অধিকসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ফ্যাকাল্টি মেম্বার (বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতও হতে পারে) এবং বিদেশি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতার জন্য আকৃষ্ট করার মাধ্যমে নিজেদের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে (৪৪) তুলনায় আমাদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত (১০-২০) তুলনামূলকভাবে ভালো থাকলেও আমাদের নিম্ন গড়ের শিক্ষাদান খ্যাতি, কম প্রাতিষ্ঠানিক আয় এবং স্নাতকোত্তর ছাত্র ও ডক্টরেট সম্পন্ন শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম রয়েছে। আমরা সাইটেশনে ক্রমবর্ধমান ভালো করছি কিন্তু গবেষণার উৎপাদনশীলতা, আয় এবং খ্যাতিতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের কমিউনিটির কাছে গবেষণাকে পণ্য বা পরিষেবায় রূপান্তর করতে হবে এবং ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া সংযোগ শক্তিশালী করতে হবে, ফলে ধীরে ধীরে একটি উদ্ভাবনী শিক্ষা ইকোসিস্টেম তৈরি হবে।

টাইমস, কিউএস বা আমাদের নিজস্ব কাস্টমাইজড ফরম্যাট অনুসরণ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জাতীয় র‌্যাঙ্কিং সিস্টেম থাকা উচিত। যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং বাইরের গবেষণা অনুদান থেকে আয় করবে, তখন তারা বিদেশ থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভিজিটিং প্রফেসর এবং বিশেষজ্ঞদের সহজে আনতে পারবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্স বা প্রোগ্রাম অফার করা উচিত হবে না। শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক কিন্তু অনুকূল একাডেমিক পরিবেশ থাকতে হবে। এটি আমাদের স্নাতক শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা ও আন্তর্জাতিক আউটলুকের মান উন্নত করবে। কর্মক্ষমতাভিত্তিক বিনিয়োগ, গবেষণা অনুদান, একাডেমিক উৎকর্ষ স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চালু করা দরকার।

বিশ্বের অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ডিজিটাল ক্যামেরুন, ডিজিটাল পাকিস্তান, ডিজিটাল নাইজেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা অনুসরণ করা হয়। ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশে ভালো র‌্যাঙ্কের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে তা সত্যিই লজ্জাজনক হবে। আমাদের অনেক সুবিধা রয়েছে, যেমন জনবল খরচ কম, স্নাতক শিক্ষার মান তুলনামূলক ভালো, গ্রহণযোগ্য শিক্ষক–ছাত্র অনুপাত ইত্যাদি। এখন আমাদের স্নাতকোত্তর গবেষণা, প্রকাশনা, তহবিল, গবেষণার বাণিজ্যিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিক এক্সপোজার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের শিক্ষার ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের অচিরেই একটি প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ র‌্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বৈশ্বিক শিক্ষার বাজারে উৎকর্ষসাধনের জন্য আমদের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে।

ড. মো. আকতারুজ্জামান পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি।