কে হতে চায় বেকার যুবক

চাকরি মেলায় চাকরির খবরাখবর নিতে এসেছেন দর্শনার্থীরা l ফাইল ছবি
চাকরি মেলায় চাকরির খবরাখবর নিতে এসেছেন দর্শনার্থীরা l ফাইল ছবি

বেকার যুবক—এই পরিচয়ে কে পরিচিত হতে চায়! অথচ বাংলাদেশের মোট ২ কোটি যুব শ্রমশক্তির মধ্যে ১৯ লাখকেই এই পরিচয়ের গ্লানি বহন করতে হচ্ছে। এ বছরের মার্চ মাসে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশ্লেষণের পর থেকে এটি বেশ আলোচিত হচ্ছে। সে সময় গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রথম আলোয় মশিউল আলমের লেখা কয়েকটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ। আর তার পরিপ্রেক্ষিতে পাঠকের (বিশেষ করে তরুণদের) দিক থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছিল, তা থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বিষয়টি কতটা গুরুতর। তরুণসমাজের যে বিশাল অংশ মাসের পর মাস (এমনকি কেউ কেউ বছরের পর বছর) ‘না লেখাপড়া, না কাজে’ দিন কাটায়, তারা যে দেশের সমাজ ও অর্থনীতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করবে, এটা বুঝতে উঁচু দরের গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ রকম পরিস্থিতিতে সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলো তরুণসমাজের ভাবনা নিয়ে একটি জরিপের ফলাফল, যা থেকে দেখা যায় যে দেশের অধিকাংশ (প্রতি পাঁচজনের চারজন) তরুণ তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র নিয়ে চিন্তিত। কারণ অতি সংগত। লেখাপড়া শেষে শ্রমবাজারে প্রবেশের পর কে কবে চাকরি পাবে বা নিজে উপার্জনক্ষম কিছু করে স্বাবলম্বী হতে পারবে, সে বিষয়ে অনেকেই অনিশ্চিত। আর তরুণদের মধ্যে উচ্চ হারে বেকারত্ব, হতাশা ও উৎকণ্ঠা কোনো সমাজের জন্যই ভালো হতে পারে না।

তরুণদের বেকারত্ব সমাজ ও ব্যক্তি সবার জন্যই  অপচয়। তাদের সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর অর্থ হচ্ছে এই যে শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশ থেকে দেশ ও তার অর্থনীতি কোনো সুফল পাচ্ছে না। অন্যদিকে তারা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল থেকে যাচ্ছে; কারণ বেকার অবস্থায় তাদের জন্য আর কোনো সহায়তা নেই। দ্বিতীয়ত, তরুণ বয়সে বেকারত্বের কারণে তাদের ওপর যে প্রাথমিক ক্ষত সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব সারা জীবনই থেকে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, দেরিতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার কারণে তার প্রভাব পড়ে ভবিষ্যতের কর্মজীবন ও উপার্জনের ওপরও। তৃতীয়ত, তরুণসমাজের বেকারত্ব সমাজের স্থিতিশীলতার জন্যও ভালো কিছু নয়। কোনো কোনো সময় অবশ্য তাদের সময় আর প্রাণশক্তি ইতিবাচক দিকেও প্রবাহিত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ‘আরব বসন্ত’ শুরুর পেছনে তাদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে তারা আবার জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের মতো ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সহায়ক শক্তিও হয়ে উঠতে পারে। মাদকাসক্তি ও অন্যান্য অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কার কথাও বাদ দেওয়া যায় না।

সুতরাং তরুণদের বেকারত্ব, হতাশা আর উৎকণ্ঠা থেকে বের করে আনতে হবে, যাতে তারা জীবনকে ইতিবাচক দিক থেকে দেখতে পারে এবং অর্থনীতিতে, সমাজে ও পরিবারে তাদের যথাযথ অবদান রাখতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে সেটা করা যায়? এই প্রশ্নের প্রথম ও প্রধান উত্তর কর্মসংস্থান। ‘বেকার যুবক’—এই তকমার গ্লানি থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু এ জন্য করণীয় কী?

সমস্যার সমাধান খুঁজতে হলে বের করতে হবে তার কারণ; আর বেকারত্বের জন্য সাধারণভাবে দায়ী করা হয় শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবকে। কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। যদি হতো, তাহলে আরও বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। অথচ বাংলাদেশে (এবং আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশেই) শিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি। শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার কম শিক্ষিতদের চেয়ে বেশি। তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়? প্রথমেই দেখা যাক, উপাত্ত ও তথ্য থেকে কী বোঝা যায়।

যেসব দেশে সাধারণভাবে বেকারত্বের হার বেশি, সেসব দেশে যুবকদের মধ্যেও এই হার বেশি। তার অর্থ এই যে দেশের সার্বিক কর্মসংস্থানের সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যকার সম্পর্ক ইতিবাচক, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে এর উল্টো। সোজা কোথায়, উন্নত দেশে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে তা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতেও যুবকদের বেকারত্বের সমস্যা বেশ গুরুতর। তবে অনেক উন্নত দেশে এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষ নীতিমালা রয়েছে, যেটি ‘অ্যাকটিভ লেবার মার্কেট পলিসি’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ এবং শ্রমবাজারে চাকরিপ্রার্থী ও নিয়োগকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণের ব্যবস্থা। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যেসব দেশে এই নীতিমালার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয় এবং কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করা হয়, সেসব দেশে যুব বেকারত্ব কম।

উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়, যার ফলে তরুণেরা স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই বৃত্তিমূলক ও শ্রমবাজারমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। বিশেষ করে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। আর এ দুটি দেশে সাধারণ বেকারত্ব ও যুব বেকারত্ব উভয়ের হারই অন্যান্য দেশের চেয়ে কম।

শিক্ষানবিশি ব্যবস্থাও তরুণদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়ার আগেই কর্মজগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। অনেক উন্নত দেশে গ্রীষ্মকালীন চাকরি তরুণদের শ্রমবাজারে প্রবেশ সহজ করে দেয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের চাকরির সঙ্গে প্রকৃত চাকরির বিশেষ মিল দেখা যায় না (সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সাঁতারের পুলে লাইফ গার্ডের কাজ করেছিলেন এবং সেই সময়ের একটি ছবি তাঁর হোয়াইট হাউসের অফিসে টাঙানো ছিল)। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কোনো কোনো দেশে উদ্যোক্তাদের শিক্ষানবিশি ব্যবস্থাতে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনাও দেওয়া হয়।

উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়ার অর্থ এই নয় যে তা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান পুরোপুরি আমাদের দেশে কাজে লাগানো যাবে। তবে তা থেকে আমাদের সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে কিছু হলেও ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমত, যেকোনো দেশের অর্থনীতিতেই প্রবৃদ্ধি ও তার সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে সেখানেই মূল সমস্যা: এ দেশে উচ্চ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। তা ছাড়া সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সেই হার আরও কমেছে বলে মনে হয়। নীতিমালা প্রণয়নকারীদের প্রথমেই এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। তারপর আসবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কীভাবে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায় এবং শিক্ষার জগৎ থেকে কর্মজগতে প্রবেশের প্রক্রিয়াকে কীভাবে আরও মসৃণ করা যায়।

শিক্ষার গুণগত মান অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে শিক্ষার বিষয় নির্ধারণে আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন, আর সে ব্যাপারে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বা তাদের অভিভাবকেরা যথেষ্ট পরামর্শ পাচ্ছেন বলে মনে হয় না। ইতিহাস, দর্শন এমনকি অর্থনীতি বা ব্যবসা প্রশাসনের লাখ লাখ স্নাতকের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা কি তাঁরা জানেন?

কারিগরি শিক্ষার ওপর এখনো যথেষ্ট জোর দেওয়া হচ্ছে না; অথচ দেশে যে দক্ষ শ্রমিক ও মাঝারি ব্যবস্থাপকের বিরাট ঘাটতি রয়েছে, তা আর এখন অজানা নয়। তবে ঢালাওভাবে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও বেকারত্ব রয়েছে; তবে তা সাধারণ শিক্ষাপ্রাপ্তদের তুলনায় বেশ কম। তা ছাড়া এই খাতে প্রশিক্ষণকে শ্রমবাজারের প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বিত করার কিছু প্রচেষ্টা চলছে, যা থেকে হয়তো সুফল পাওয়া যাবে। আর এটা অস্বীকার করা যাবে না যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে (অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত) কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোকেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি বাড়বে। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, চীন—এসব দেশের অভিজ্ঞতা এই দিকেই নির্দেশনা দেয়। সুতরাং এ ধরনের দক্ষতার অভাব একদিকে যেমন উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, অন্যদিকে শ্রমবাজারেও কর্মপ্রার্থীদের জন্য সুযোগ সীমিত করে দিতে পারে।

উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা এবং স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টিও যুবকদের জন্য কাজের সুযোগ বাড়ানোর হাতিয়ার হতে পারে। বাংলাদেশেও এ ধরনের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, সবার মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তা ছাড়া চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে তরুণেরা যে রকম অসুবিধার সম্মুখীন হয়, উদ্যোগ সৃষ্টি ও নিয়মিত উপার্জনের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রেও সে ধরনের বাধা থাকবে না, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। সুতরাং তরুণেরা যেন সেই সব বাধা অতিক্রম করতে পারে, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের সঙ্গে অন্যান্য সহায়তা যেমন ঋণ, বাজার খোঁজা, বাজারজাত করা ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ দেওয়া হলে কর্মসূচির সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়ে।

গণপূর্ত কর্মসূচির আদলে যুবকদের জন্য বিশেষ কর্মসূচির কথা ভাবা যেতে পারে। তবে তাদের শিক্ষার স্তর ও অন্যান্য যোগ্যতার সঙ্গে কী ধরনের কাজ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, সে বিষয় বিবেচনা করেই এ রকম কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, সামাজিক সেবা, যেমন বয়স্কদের সেবা-দেখাশোনা, শিশুদের দেখাশোনার ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজ অন্তর্ভুক্ত করে এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে।

যুব বেকারত্ব সম্পর্কে ওপরে যা বলা হলো, তা একটি মোটা দাগের রূপরেখা। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা, নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সাবেক কর্মকর্তা।