কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং প্রতিরোধ

চার দশকেরও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষ করে যখন অবসরে যাই, দেখি আমার ভান্ডারে আনন্দের আর গৌরবের স্মৃতিই বেশি। ছাত্র হিসেবে যে সময়টা পার করেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, তা ছিল এক স্বর্ণযুগ। ষাটের দশকের গোড়া থেকে শুরু হওয়া স্বাধিকার আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নিল। গণতন্ত্রের জন্য সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকেরাও লড়াইয়ে নামলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি আদর্শিক অবস্থান থেকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধে এর অবদান লেখা আছে সোনার অক্ষরে।

সেই দিন কবে চলে গেছে। কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং মানবিক অবস্থান এই পাঁচ দশকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল, সে এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে—এ প্রশ্ন এখন আর ছাত্ররা করে না, শিক্ষকেরাও না। আমাদের একটা বড় অতৃপ্তি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শিক অবস্থানে ঘুণ ধরা, ক্ষয়ে যাওয়ার বিষয়টা।

এশিয়ার ৫০০টি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর অনেক শিক্ষক এখন দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখাতে ব্যস্ত, দলের বাইরে গিয়ে তাঁরা কোনো বিবেকি চিন্তাকে গ্রহণ করতে অপারগ; এর ছাত্রদেরও একটি দলে ভিড়তে হয়, না হলে হেনস্তা হয়, হলে সিট পাওয়া যায় না।

আমি দেখেছি, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার মান কমছে বলে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও ভাষাজ্ঞান থাকে দুর্বল, মৌলিক ও তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তায় তারা পিছিয়ে থাকে। ফলে তারা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দক্ষতানির্ভর কুশলতা অর্জন করতে পারে না। নিজের দেশেই তারা সেই চাকরি পায় না, যা মোটা বেতনে বাগিয়ে নেয় ভারত-লঙ্কার তরুণেরা।

ছোট হয়ে আসা চাকরির পৃথিবীতে এখন তরুণদের একটা বড় আশার জায়গা হচ্ছে সরকারি কর্মসংস্থান। এবং এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে বিসিএস ক্যাডারে চাকরি। এ জন্য এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই একজন শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে বিসিএস গাইড বই পড়ে। সকাল সাতটায় লাইব্রেরির সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে—না, বিদ্যাশিক্ষার জন্য নয়, বিসিএস শিক্ষার জন্য। বিসিএসের চাকরি এখন সোনার হরিণ।

আমার অতৃপ্তির স্মৃতিতে এই বিসিএস-ম্যানিয়ার বিষয়টি থাকবে। তবে আমি এই শিক্ষার্থীদের মোটেই দোষ দিই না। সমাজ ও রাষ্ট্র হিসেবে
আমরা তাদের একুশ শতকের জন্য তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে কোচিং–বাণিজ্যের ঠাকুরেরা, গাইড বই, নোট বইয়ের সওদাগরেরা। যেখানে একটা পিয়নের চাকরির জন্য ২-৩ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, সেখানে কারও হাত তৈলাক্ত না করে যদি একটা সোনার হরিণ চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে কেন তারা এর জন্য কোমর বেঁধে নামবে না?

কোটা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন চলছে কয়েক মাস ধরে, সারা দেশের তরুণদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বোঝার জন্য এই প্রেক্ষাপটটি মনে রাখতে হবে। এই আন্দোলনকে সরকারের একটি অংশ এবং ছাত্রলীগের নেতৃত্ব সরকারবিরোধী বলে নাকচ করে দিচ্ছে। তাদের কথায় সত্যতা কিছুটা হয়তো আছে। বিরোধী দলগুলোকে যেভাবে এক ইঞ্চি জায়গা দেওয়া হচ্ছে না, তাতে এই আন্দোলনে তাদের ইন্ধন যদি থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সার্বিকভাবে এই আন্দোলনের রূপটি তারুণ্যের একটি অধিকার আদায়ের এবং তা হচ্ছে সম্মানজনক একটি চাকরি পাওয়ার।

দেশের অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে, দেশ আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে। আমরা এখন নিজেদের অর্থে একটি বিশাল সেতু তৈরি করতে পারি। আমাদের মন্ত্রীরা বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানোর উপদেশ দিতে পারেন। এসবই এক নতুন এবং আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশের নিদর্শন। কিন্তু এই বাংলাদেশ কি তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে পারছে? এই বাংলাদেশ কি একই সঙ্গে সহিষ্ণু এবং গণতান্ত্রিক? মানবিক এবং ন্যায়পরায়ণ? পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল? নারী ও শিশুবান্ধব? পরিবেশপ্রেমী?

এই দেশ কি শিক্ষায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে এমন দক্ষ এক মানবসম্পদ তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যা দেশের সব প্রয়োজন মেটাতে সম্ভব? আমরা কি আমাদের প্রয়োজনমতো মেধাবী বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক গড়ে তুলতে পারছি? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি বিশ্বমানের পঠন-শিক্ষণ-গবেষণা হয়? এসবের উত্তর সাধারণভাবেই— না। কিন্তু ব্যতিক্রমেরও তো অভাব নেই। কিন্তু ব্যতিক্রম তো আর নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করে না।

মাঝে মাঝে আমি ইন্টারনেটে বিদেশি পত্রিকা পড়ি। বাংলাদেশের খারাপ খবর পেলেই তারা ছাপায়। গত এপ্রিলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর সবিস্তারে ছেপেছে ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ানডেইলি মেইল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা ভালো খবরও এই কয়েক বছর এসব কাগজে দেখিনি।

অথচ ষাটের দশকে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে ইংল্যান্ডের পত্রিকা পড়াটা ছিল আমার জন্য আনন্দের। ‘গণতন্ত্রের আন্দোলনে উত্তাল ঢাকার ছাত্রসমাজ’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের লৌহমানবকে রাস্তা দেখিয়ে দিল’—এ রকম শিরোনাম পড়তাম, আর রোমাঞ্চিত হতাম।

গত ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলন যেভাবে প্রতিহত করা হলো, পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হলো আন্দোলনকারীদের, হাসপাতালেও তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হলো, তা নিয়ে নিশ্চয় বিদেশের পত্রিকায় খবর বের হবে। সেসব পড়া তো দূরের কথা, দেশের কাগজেও যেসব শিরোনাম বের হয়েছে, সেগুলো সব পড়তেও আমার আগ্রহ হয়নি। 

২.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দিলেন কোটা প্রথা বিলুপ্ত হবে। তাঁর কথায় ক্ষোভ ছিল এবং তা স্বাভাবিক। মুক্তিযোদ্ধার কোটা বিলুপ্তি জাতি হিসেবে আমাদের অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করবে। আদিবাসী এবং প্রতিবন্ধীদের কোটা বিলুপ্তি আমাদের সংখ্যাগুরুর গায়ের জোর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রমাণ করবে। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী এই কোটাগুলো বহাল রেখে পদ্ধতিটি সংস্কারে সম্মতি দেবেন।  

লাখ লাখ তরুণের আবেগ যেখানে জড়িত, সেখানে কেন এই কালক্ষেপণ? আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যদি আলাপ হতো, ১০-১৫ শতাংশ কোটা রেখে নতুন একটি পদ্ধতি ঘোষিত হতো, তাহলে তার পুরো সুফল যেত সরকারের ঘরে। তা না করে আন্দোলনকারীদের দমনে ছাত্রলীগ নামল, তাদের ওপর হামলা হলো।

আমাকে যা অবাক করেছে, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভিন্ন চিন্তা প্রকাশের পরিসর এখন আর নেই।

এ বছরটি নির্বাচনের। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন তাঁর দলের তৃণমূলের নেতাদের নিয়ে বসেছেন। বলেছেন, নির্বাচনে জিতে আসতে হবে। কিন্তু নতুন যে এক কোটির মতো ভোটার নির্বাচনে ভোট দেবে, যাদের সিংহভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়, তারা কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রতিহত করার খবরগুলো পড়ে কী ভাববে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কি তা ভেবেছেন? তারা তো ভোটের বাক্সে তাদের আপত্তিটা জানিয়ে দিয়ে আসতে পারে।

সুখের কথা, এই লেখাটি শেষ করে আনতে আনতেই দেখলাম ২ জুলাই সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিয়েছে, যাকে পনেরো কার্যদিবসে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

সময়সীমা মেনে কমিটি তার প্রতিবেদন দিলে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে একটি অনাবশ্যক সংঘর্ষ এবং সহিংসতার জায়গায় আমরা শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারব।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ