একসময় ক্রেতারা তাঁদের সাধ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবচেয়ে বড় আকারের পশুটিকে কোরবানির জন্য সংগ্রহ করতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানের ক্রেতাসাধারণ কোরবানির পশুর আকারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মুখরোচকতার বিষয়টিও প্রাধান্য দেন।
খেতে সুস্বাদু ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত মাংস হওয়ায় ক্রেতাসাধারণ এখন দেশি গরুকে পছন্দের শীর্ষে রাখছেন। তাই দেশি গরুর চাহিদাও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশি গরুর ব্যাপক চাহিদার কথা বিবেচনা করে কিছু অসাধু চক্রের অসদুপায় অবলম্বনের ঘটনাও ঘটছে। তাই কোরবানির পশু হিসেবে যদি দেশি গরু আপনার পছন্দের তালিকায় থাকে, তাহলে পছন্দের গরুটি ঘরে আনার আগে সেই গরু সম্বন্ধে ধারণা রাখা জরুরি। তা না হলে পশু কিনে আপনি ঠকে যেতে পারেন।
বাংলাদেশে গরুর কোনো স্বীকৃত জাত নেই। তবে বর্তমানে নিচে উল্লেখ করা পাঁচ ধরনের দেশি গরু পাওয়া যায়।
স্থানীয় দেশি জাতের গরু
দেশের সবখানে এ ধরনের গরু পাওয়া যায়। এ গরু আকারে ছোট হয়। গায়ের লোম ছোট এবং দেহ চকচকে হয়। চামড়া শক্ত থাকে। এর কুঁজ সুগঠিত থাকে। গলার নিচের চামড়া বেশ বিকশিত থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক ষাঁড়ের গলার নিচের চামড়া ঝুলে থাকে। কান লম্বা এবং পাতার মতো ভাঁজ হয়ে থাকে। এদের শিং বাঁকানো থাকে। গায়ের রং লাল, সাদা, কালো, ধূসর বা ছাইরঙা কিংবা দুই বা ততোধিক রঙের মিশ্রণও হতে পারে। এদের উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত হতে পারে। দেহের দৈর্ঘ্য (সামনের পায়ের গোড়া থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব) সাড়ে তিন ফুটের আশপাশে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক একটি পুরুষ গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ১৫০ থেকে ২২০ কেজি হয়ে থাকে।
রেড চিটাগাং ক্যাটল
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাওয়া যায় এ ধরনের গরু। এর গায়ের রং লালচে। এর পাশাপাশি মুখ, চোখের পাতা, খুর, এমনকি লেজের প্রান্তও লালচে রঙের হয়ে থাকে। এ গরুর দেহ তুলনামূলক ছোট হয়। উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) সাড়ে তিন ফুটের মতো হয়। দেহ লম্বায় সাড়ে তিন থেকে চার ফুটের কাছাকাছি হয়ে থাকে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ২৫০ থেকে ৪০০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ১৫০ থেকে ২৩০ কেজি হয়ে থাকে।
পাবনা ক্যাটল
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এ গরু সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সাধারণত, এ জাতের গরুর গায়ের রং লাল বা ধূসর (ছাই রং) কিংবা এ দুই রঙের মিশেলে হয়ে থাকে। পুরুষ গরুতে এ রং গাঢ় ধূসর ও সাদা রঙের মাঝামাঝি যেকোনো বর্ণের হতে পারে। মুখ, চোখের পাতা, শিং ও লেজের প্রান্তদেশ কালো রঙের হয়। এদের দেহ লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো আর উচ্চতা (কুঁজ বরাবর) চার ফুটের মতো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২৫০ থেকে ২৮০ কেজি হয়ে থাকে।
নর্থ বেঙ্গল গ্রে
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় নর্থ বেঙ্গল গ্রে গরুর দেখা মেলে। এর গায়ের রং সাদা বা গাঢ় ধূসর ও সাদা রঙের মাঝামাঝি, যেকোনো রঙের হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গরুর ঘাড়ে ছাই রঙের ছোপ দেখা যায়। মুখ, চোখের পাতা ও খুর কালো রঙের হয়ে থাকে। তবে লেজের প্রান্ত সাদা রঙের হয়। গরুর শিং ছোট বা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে এবং শিং ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর উচ্চতা তিন ফুটের একটু বেশি এবং দেহের দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন ফুটের কাছাকাছি হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৫০ কেজি হয়ে থাকে।
মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল
মুন্সিগঞ্জ ক্যাটল প্রধানত মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম উপজেলায় পাওয়া যায়। এ গরুকে সাধারণত ‘মীরকাদিমের গরু’ বলা হয়। মুন্সিগঞ্জ ছাড়া এর পার্শ্ববর্তী জেলাতেও এ গরুর দেখা মেলে। মীরকাদিম জাতের গরুর গায়ের রং মূলত সাদা। তবে দেহের বিভিন্ন স্থানে হালকা গোলাপি রঙের আভাও দেখা যায়। শিং, চোখের পাতা, খুর ও লেজের প্রান্তদেশ গোলাপি বা গোলাপি ও কালো রঙের মিশেল হতে পারে। পূর্ণবয়স্ক একটি গরুর উচ্চতা ৩ থেকে ৫ ফুট হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গরুর ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ কেজি ও স্ত্রী গরুর ওজন ২০০ থেকে ২৮০ কেজি হয়ে থাকে।
ওপরের বৈশিষ্ট্যগুলো মাথায় রাখতে পারলে যেকোনো ক্রেতা কোরবানির হাটে সহজেই দেশি গরু চিহ্নিত করতে পারবেন।
ড. এ কে এম এম হুমায়ুন কবির চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
[email protected]