কোয়াডের ব্যাপারে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে

সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলেছে, যা পশ্চিমা বিশ্ব ও এশিয়া-প্যাসিফিক দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত চীনের এই দ্রুতগতির প্রভাব বিস্তারকে ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কোয়াডের আবির্ভাব। চীনের আধিপত্যকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এশিয়া-প্যাসিফিক এলাকায় এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখাই কোয়াডের মূল লক্ষ্য। কোয়াড দেশগুলোর নেতাদের সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনে সরাসরি চীনের কথা বলা না হলেও হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলা হয় যে কোয়াড ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে নবপ্রবর্তনের মাধ্যমে, স্বাধীন, উন্মুক্ত, স্থিতিশীল ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য সব ধরনের প্রযুক্তিকে এক করতে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে সব সামুদ্রিক নিয়মকানুন রক্ষা করতে প্রস্তুত। অবশ্য সৃষ্টিকালে কোয়াডের মূল উদ্দেশ্য বর্তমান থেকে অনেকটা আলাদা ছিল, কালের পরিবর্তনে এর লক্ষ্য ও মতাদর্শ অনেকটাই বদলে গেছে।

তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রথম ২০০৭ সালে দেশগুলোর মধ্যে একটি ‘কোয়াড্রি ল্যাটেরাল স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের’ প্রস্তাব দেন। এর আগে এই চার দেশ অন্যান্য কারণে একত্র হলেও, আবের প্রস্তাবের পরেই প্রথম কোয়াড দেশগুলো ও সিঙ্গাপুর এক হয়ে একটি সামুদ্রিক সামরিক অনুশীলন করে। পরে এর পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে। পরে প্রশ্ন ওঠে, এই সংলাপের ফোরাম কি এই সামরিক অনুশীলনেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি একটি সামরিক চুক্তিতে রূপ নেবে? যে প্রশ্ন এই সময়ে এসেও আবার উঠছে।

২০০৮ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়া কোয়াড থেকে সরে যায় এবং ঘোষণা দেয় যে কোয়াড বা এমন কোনো ডায়ালগে অংশগ্রহণ করতে তারা আর ইচ্ছুক নয়, যা কোয়াডের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটি শুধু কোয়াডের সমাপ্তিকেই ইঙ্গিত করে না, বরং চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠতা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করে। আমেরিকার জন্য এই অঞ্চলের তা বড় ঝুঁকির শামিল। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে কোয়াডের পুনরুত্থান ঘটে এবং সদস্যদেশগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করা শুরু করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ঠিক করা হয় ‘স্বাধীন, উন্মুক্ত ও নিরপেক্ষ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল’, যার ভিত্তি হবে বিস্তৃত ও দেশভিত্তিক পৃথক পর্যালোচনা। এই পুনরুত্থানের পর কোয়াড আবারও সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং সবাই এর পরবর্তী গতিপথ বোঝার চেষ্টা করছে।

ধারণা করা হয়, কোয়াডের গতিপথ এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এমনকি বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, শিগগিরই এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক চুক্তিতে রূপ নিতে পারে। এককথায় কোয়াড হতে পারে ‘এশিয়ান ন্যাটো’। এর মাধ্যমে এ অঞ্চলের সামরিকীকরণের বিষয়টাও সামনে জোরদার হবে বলে অনেকে মনে করেন। কোয়াডভুক্ত চার দেশের ‘মালাবার যৌথ নৌ মহড়া’ তার ইঙ্গিত দেয়। এই মহড়ার মধ্য দিয়ে সামরিক শক্তির একটি প্রদর্শন হয়েছে, যা কার্যত চীনের জন্য একটি সংকেত। এ ছাড়াও কোয়াড দেশগুলো একে অপরের অন্যান্য বহুপক্ষীয় সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করছে। এর মধ্যে ‘দ্য রিম অব প্যাসিফিক এক্সারসাইজের (রিমপ্যাক)’ কথা উল্লেখ করা যায়, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ নৌ মহড়া হিসেবে বিবেচিত। পরস্পরের সঙ্গে এমন একাত্মতা ও দেশের সর্বোচ্চ স্তরে এটির প্রাধান্য পাওয়া কোয়াড বিশ্বরাজনীতিতে একটি দূরদর্শী উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ধারণা করা হচ্ছে যে কোয়াড তার কার্যপরিধি ও ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আরও কিছু আঞ্চলিক দেশকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতে পারে। প্রথমত, তারা এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে নৌ অনুশীলনের প্রস্তাব দিতে পারে। সাউথ কোরিয়ার সঙ্গে ‘প্যাসিফিক ভ্যাঙ্গার্ড’ নামের নৌ অনুশীলন তার একটি উদাহরণ। এর পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তারা ইতিমধ্যে ‘ফাইভ পাওয়ার ডিফেন্স অ্যারেঞ্জমেন্ট’ ও ‘ফাইভ আইজের’ মাধ্যমে কোয়াডের সঙ্গে সহযোগিতা শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ড এর সঙ্গে যুক্ত হলে কোয়াডের জন্য লাভজনক হবে। কারণ, এতে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও বিস্তৃত হবে। দ্বিতীয়ত, তারা পশ্চিমের কিছু দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, যাদের স্বার্থ ইন্দো-প্যাসিফিকের সঙ্গে যুক্ত। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, কারণ এই অঞ্চলে দেশ দুটির স্বার্থ রয়েছে। ফ্রান্সের বেশ কিছু উপনিবেশ ভূখণ্ড এখনো এখানে আছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য তাদের মনোযোগ এই অঞ্চলের দিকে প্রসারিত করছে এবং কমনওয়েলথের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

সরাসরি সদস্যদেশ সংযুক্তি ছাড়াও তারা ‘প্লাস প্রসেসে’ এগোতে পারে, যেমনটা দেখা যায় ‘আসিয়ান’-এর ক্ষেত্রে—‘আসিয়ান+ ৩ করপোরেশন’। এতে তারা ‘কোয়াড+’ বা এ ধরনের উদ্যোগে যেতে পারে, যাতে মূল উদ্দেশ্য ঠিক রেখে সদস্যসংখ্যা বাড়ানো যায় এবং পাশাপাশি ছোট দেশগুলোর সঙ্গেও মেলবন্ধন বাড়ানো যায়। ছোট রাষ্ট্রগুলোকে যদি তারা ‘সাপোর্ট ক্লাস্টার’ হিসেবে রাখতে পারে, তবে এই অঞ্চলের ‘যৌথ নিরাপত্তা’ তাদের আওতাধীন থাকবে এবং কোয়াড যেকোনো কার্যক্রম ও সহযোগিতা আরও স্বাচ্ছন্দ্যে পরিচালনা করতে পারবে। এই পথ অনুসরণ করে এই অঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোকে একসঙ্গে আনতে পারলে তা হবে কোয়াডের জন্য দূরদর্শিতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং কৌশলগতভাবে প্রাসঙ্গিক।

কোয়াডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুধু এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং সাম্প্রতিক বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তারা এগোচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাদেও তারা তাদের যৌথ বিবৃতিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ন্যায্য বণ্টনের বিষয়গুলোও স্থান পেয়েছে। কোভিড-পরবর্তী বহুমাত্রিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশগুলো যখন কোভিড-১৯ মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন প্রথম চীন ও রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন সরবরাহের মাধ্যমে একধরনের নিবিড় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে যদি চীন বা রাশিয়া তাদের প্রভাব বিস্তার বা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম বা ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে নির্ভরতার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তবে তা কোয়াডের মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে এই ‘টিকা কূটনীতি’ প্রয়োগ করার জন্য হলেও কোয়াড তাদের টিকা বিতরণ প্রকল্প এ অঞ্চলে সম্প্রসারিত করবে।

কোয়াডের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব রোধ করা, যা স্বাভাবিকভাবেই কৌশলগত বৈসাদৃশ্যের সূচনা ঘটাবে এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও তার আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এমনকি চীন, আফগানিস্তান, নেপাল ও পাকিস্তান ‘ট্রান্স-হিমালয়ান মাল্টিডাইমেনশনাল কানেকটিভিটি নেটওয়ার্ক’ নামে যে চারপক্ষীয় আলোচনায় যুক্ত হয়েছে, তাকে অনেকে ‘হিমালয়ান কোয়াড’ বা কোয়াডের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন। অবশ্য চীন এই বিষয়টি অস্বীকার করছে এবং কোয়াডের বিরুদ্ধে তাদের তরফে কোনো বিবৃতি এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো একটা সমঝোতায় যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তারা চায় না দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশ কোয়াডের সঙ্গে যুক্ত হোক। এমনকি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার চীনের রাষ্ট্রদূতের মারফত একধরনের ‘হুঁশিয়ারি’ পেয়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যদি কোয়াডে অংশগ্রহণ করে, তবে তা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে। বাংলাদেশ অবশ্য কোয়াড থেকে কোনো আমন্ত্রণ পায়নি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, আঞ্চলিক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। কোয়াডের যদি আসলেই সামরিকীকরণ হয়, তবে পক্ষ হবে দুটি—চীনের পক্ষে অথবা কোয়াডের পক্ষে।

কোয়াডের মতো কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে খুবই কৌশলী হতে হবে। নিজেদের স্বার্থ বুঝে, প্রায়োগিক কূটনীতি ব্যবহার করে এবং যথাসম্ভব ভারসাম্য রক্ষা করেই এগোতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে কোয়াড বা যেকোনো একপক্ষীয় জোটে যোগ দেওয়া সমীচীন হবে না। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং একই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভূরাজনীতিতে নিজের যথোচিত অবস্থান টিকিয়ে রাখতে কৌশলগত নিরপেক্ষতার বিকল্প নেই।

আ ন ম মুনীরুজ্জামান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল, এনডিসি পিএসসি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি