ক্ষমা করো মেয়ে

কয়েক দিন আগে ঘুরে এলাম নেপাল থেকে। ছোটবেলা থেকেই অনেক শুনেছি হিমালয়-কন্যা নেপাল সম্পর্কে। তাই ইচ্ছা ছিল খুব কাছ থেকে দেশটিকে দেখার। প্রাচীন স্থাপত্যকলায় আর অনিন্দ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অধিকারী নেপাল সত্যিই অতুলনীয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে দেশটির ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর বেশ ক্ষতি হয়েছে। তবে আশার কথা, সংস্কারকাজ চলছে পুরোদমে। পূর্বধারণা থাকলেও বাস্তবের নেপালের বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পুরাকীর্তি অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে আমাকে। তবে তার চেয়েও মুগ্ধ করেছে দেশটির সহজ-সরল মানুষগুলো।
আরেকটি বিষয় ছিল লক্ষ করার মতো: নেপালে দেখেছি নারীর নির্ভীক পদচারণ। অনেক সমস্যায় জর্জরিত দেশটির নারীদের নিরাপত্তার চিত্র অবাক করার মতো। দোকানপাট, হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্ট চালনায় যেমন তাঁদের সপ্রতিভ উপস্থিতি, তেমনি দিনে কিংবা রাতে জিনস প্যান্ট, সালোয়ার-কামিজ এমনকি শাড়ি পরা নেপালি নারীদের মোটরসাইকেল কিংবা স্কুটিতে গতিময় উপস্থিতিও চোখে পড়েছে। মনে হয়েছে, ঠিক এই জায়গায় আমরা নেপাল থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তাই বাংলাদেশের নারীদের অনিরাপদ ও নাজুক সামাজিক অবস্থান দেশটির অনেক অর্জনকে ম্রিয়মাণ করে দেয়।
যে যেভাবেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তবতা এই যে বাংলাদেশে নারীরা আজও অরক্ষিত কিংবা সুরক্ষিত নন। একজন নারী হিসেবে এ আমার উপলব্ধিও বটে। আমি সুরক্ষিত ছিলাম না আমার শৈশবে কিংবা কৈশোরে। আজও আমি সুরক্ষিত নই। বিশেষ করে মনে পড়ে বাংলাদেশের একটি জেলা শহরে বেড়ে ওঠা আমার কৈশোরের দিনগুলো, যখন আমিও কমবেশি এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিলাম। কৈশোরের যে দিনগুলো রঙিন স্বপ্ন হয়ে মনের কোণে উঁকি দেওয়ার কথা, তার পরিবর্তে স্কুলের পথে বাইকযোগে রোজ পিছু নেওয়া ষন্ডামার্কা ছেলেটি আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় আমার মনে। শুধু কিশোরী কিংবা তরুণী নয়, এই সমাজে নিরাপদ নন কোনো নারী।
সন্ধ্যার পর বাংলাদেশের কোথাও নারীর একা হাঁটাচলা নিরাপদ নয়। জানি, অনেকেই বলবেন বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের কথা, নারীদের নানা অর্জনের কথা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এ ক্ষেত্রে নারীরা কিছুটা এগিয়েছেন। কিন্তু রূপা, তনু, খাদিজা কিংবা রিসার পরিণতি নিয়মিত বিরতিতে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নারীর ক্ষমতায়নের নামে প্রজ্বলিত প্রদীপের শিখার নিচে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের কথা। নারীর ক্ষমতায়নের অর্থ শুধুই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নয় কিংবা কিছু কর্মক্ষেত্রে নারীর বিচরণ নয়। বরং নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায় ঘরে কিংবা বাইরে নারীর চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, নিজের ইচ্ছামতো পেশা নির্বাচনের ও কাজ করার অধিকার। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এটা একজন নারীর বাড়তি কোনো চাওয়া নয়। বরং একজন মানুষ হিসেবে এই সামান্য চাওয়াটুকু তাঁর অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
এই সমাজে প্রতিনিয়ত বড্ড বেশি বৈরী পরিবেশের মোকাবিলা করে পথ চলতে হয় একজন নারীকে। গর্ভকালীন দীর্ঘ ১০ মাস সে একাকী পাড়ি দিয়েছে, একাই সয়েছে প্রসবযন্ত্রণা, প্রসব-পরবর্তী সময়ে সন্তান পালন করেছে পরম মমতায় কারও কাছে কোনো সাহায্যের প্রত্যাশা না করেই। সে নিজেকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দিয়েছে সবার স্বার্থে। পরিবার ও সমাজের কাছে কিন্তু তার তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সে শুধু চেয়েছে পরিবার ও সমাজ তাকে দেবে সামান্য সম্মান আর নিরাপত্তা। কিন্তু আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজ পারেনি নারীর এই ন্যূনতম চাওয়াটুকু পূরণ করতে। তাই তো তনুকে মৃতদেহ হয়ে পড়ে থাকতে হয় ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তাবলয়ের ভেতরে, চলন্ত বাসে গণধর্ষিত হয়ে ঘাড় মটকানো নিথর রূপাকে পড়ে থাকতে হয় শালবনের ভেতরে, ভয়ার্ত তৃষার ছোট্ট মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় শীতল জলরাশি থেকে।
আমরা কীভাবে নিরাপত্তা দেব এই অসহায় মেয়েগুলোকে? কীভাবে বাঁচাব এদের এই হায়েনাদের হাত থেকে? আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি নারীর নিরাপত্তার মতো মৌলিক একটি বিষয়। বরং যতই দিন যাচ্ছে, সংকটটি আরও ঘনীভূত হয়ে উঠছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একের পর এক রক্ত হিম করা ঘটনা ঘটার পরও সরকারকে তেমন নড়েচড়ে বসতে দেখি না। মিডিয়ায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনাগুলো কয়েক দিন ঝড় তোলে; তারপর সে ঝড় আপনি থেমে যায়। কিন্তু থামে না সিমি, তৃষা, ইয়াসমিন, তনু, রিসা কিংবা রূপার পরিবারের মানুষগুলোর মনের ঝড়, তাদের চোখের পানি ঝরতে থাকে অবিরাম। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, কেউ তা শোনে না।
নেপালের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের কথা বলছিলাম। এ সৌন্দর্য শাশ্বত ও চিরন্তন। কিন্তু আমার চোখে নেপালের আসল সৌন্দর্য হয়ে ধরা দিয়েছে এই দেশের অসাম্প্রদায়িক, লিঙ্গবৈষম্যমুক্ত সহজ-সরল মানুষগুলো। পোশাক যে নারীকে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম এবং একই সঙ্গে নারীর নিরাপত্তা যে প্রকৃতপক্ষে পুরুষের ও সমাজের নারীকুলকে সম্মান করার মধ্যে নিহিত, তা নেপালিদের কাছ থেকে শিখতে হয়। নারীর নিরাপত্তা বিধানে একদিকে যেমন প্রয়োজন রাষ্ট্রের আন্তরিকতা, আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা, ঠিক একইভাবে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা।
পুত্রসন্তানের অভিভাবকদের বলতে চাই, সামাজিক অবক্ষয়ের এই সময়ে একটি পুত্রসন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা কন্যাসন্তানকে বড় করার চেয়ে ঢের বেশি কঠিন। যিনি আজ পুত্রসন্তান লাভ করে নিজেকে গর্বিত মনে করছেন, অদূর ভবিষ্যতে সেই পুত্রসন্তান যে কুসন্তানে পরিণত হবে না এবং পরিবারটির দর্পচূর্ণের কারণ হবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরিবারই সব শিক্ষার সূতিকাগার। যে ছেলেটি তার পরিবারে নারীকে সম্মানিত হতে দেখে, সে নারীকে সম্মান করতে শেখে। আসুন, আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নিজেরা সচেতন হই, সচেতন করি পুত্রসন্তানসহ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে। আমরা চাই এই সমাজে নারী মানুষ হয়ে বাঁচুক। শঙ্কামুক্ত হোক নারীর পথচলা।

নিশাত সুলতানা : কর্মসূচি সমন্বয়কারী, জেন্ডার জাস্টিস ডাইভারসিটি ডিভিশন, ব্র্যাক।
[email protected]