খুলনায় ৭৫ বছরের স্কুল: সেন্ট জোসেফস

যত দূর মনে পড়ে, সেবার যশোর শিক্ষা বোর্ডে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে কোনো একটি সংখ্যায়। তখন বরিশালে আলাদা শিক্ষা বোর্ড হয়নি। সুতরাং, যেসব স্কুল যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন ছিল, তার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি ছিল দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় পরীক্ষার প্রশ্ন ছিল কঠিন। ফলে পাসের হার ঢাকা, কুমিল্লা ও রাজশাহীর তুলনায় অনেক কম ছিল—সম্ভবত ২১ শতাংশের মতো। যশোর বোর্ডে সেবার প্রথম শ্রেণি পেল মাত্র পাঁচ শর কিছু বেশি। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে একটি স্কুলের পরীক্ষার্থীর ৯৫ শতাংশই পেল প্রথম শ্রেণি। সালটা ১৯৭৬। স্কুলটির বয়স তখন ৩৬ বছর। আজ তার ৭৫। খুলনার সেন্ট জোসেফস হাই স্কুলের অনেক অর্জনের মধ্যে ১৯৭৬ মাত্র একটি। এ রকম অনন্য রেকর্ড নিশ্চয় আরও আছে, যেগুলোর খোঁজ আমি আর করিনি। কিন্তু আজ স্কুলটির প্লাটিনাম জুবিলিতে শুধু একটাই প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে যেন এমন আরও অনেক ভালো রেকর্ডের জন্ম দেয় আমার প্রিয় সেন্ট জোসেফস। অবশ্য, যাঁরা ঢাকার সেন্ট যোসেফের কথা জানেন কিন্তু দেশের প্রায় একটি প্রান্তে সুন্দরবনের কোলে অবস্থিত খুলনার সেন্ট জোসেফস স্কুলের কথা জানেন না, তাঁদের জানিয়ে রাখি, ঢাকারও ১৪ বছর আগে ১৯৪০ সালে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় ১৯৪৩ সালে।
একাত্তরে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর সদ্য স্বাধীন দেশটির প্রথম কয়েক বছরে শিক্ষাব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল। প্রথম বছর—১৯৭২ সালে হলো অটো পাস, অর্থাৎ পরীক্ষা না দিয়েই সেবার ছাত্রছাত্রীরা পরের ধাপে উঠতে পেরেছিল। ’৭৩-৭৪-এ নকলের ছড়াছড়ি। কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে পাবলিক পরীক্ষা বা জাতীয় পরিসরে অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলোতে কড়াকড়ি। ’৭৬-এ আমরা সেই কড়াকড়ির মধ্যে পড়ে যাই। কিন্তু পুরো শিক্ষা বোর্ডে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ ছাড়া আর হাতে গোনা যে কয়েকটি স্কুল লেখাপড়ার মানে উন্নতি ঘটাতে পেরেছিল, তার মধ্যে সেন্ট জোসেফস বা কথ্যভাষায় যোসেফ স্কুল বলা চলে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিল। তখন আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত অমিয় গ্যাব্রিয়েল মল্লিক। কিন্তু স্কুলে তাঁর আগের কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই পদচারণ ঘটত স্কুলের আরেক পৃষ্ঠপোষক ও সাবেক প্রধান শিক্ষক ফাদার এজি ব্রুনোর।
বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে আমাকে কম করে হলেও পাঁচবার স্কুল বদলাতে হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তখনকার অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলও ছিল। প্রায় তিন মাইল মেঠো পথ হেঁটে, কখনো ধানখেতের আইল ধরে স্কুলে যেতাম। তবে, অষ্টম শ্রেণি থেকে আমার জায়গা হয় জোসেফস স্কুলে। আমার স্কুলজীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিও ওই স্কুলকে ঘিরে। আমার ইংরেজির ভিত্তিটা ধরিয়ে দিয়েছেন আজহার স্যার, অঙ্ক ও পদার্থবিজ্ঞান নিত্যলাল গোলদার, বাংলা ব্যাকরণ হাবিব স্যার। কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হিমাংশু স্যার। স্কাউটিংয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন মরহুম সাখাওয়াত স্যার। খুলনায় যতগুলো স্কুল আছে, তার মধ্যে আমাদের সময়ে একমাত্র বাস্কেটবল খেলার ব্যবস্থা ছিল আমাদের সেন্ট জোসেফসেই। তবে, আমার বন্ধুরা যারা ভালো খেলত, তাদের অনেককে দেখে আমার ঈর্ষাই হতো। কেননা, খেলাধুলাটা আমার ঠিক হয়ে ওঠেনি। সেসব বন্ধুর অনেকেই এখন প্রবাসে। সংস্কৃতিচর্চা কিংবা লেখালেখি যতটুকু করেছি বা করি, তার সবটার জন্যই আমি ঋণী আমার এই স্কুলের কাছে।

>যশোর বোর্ডে সেবার প্রথম শ্রেণি পেল মাত্র পাঁচ শর কিছু বেশি। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে একটি স্কুলের পরীক্ষার্থীর ৯৫ শতাংশই পেল প্রথম শ্রেণি। সালটা ১৯৭৬। স্কুলটির বয়স তখন ৩৬ বছর। আজ তার ৭৫। খুলনার সেন্ট জোসেফস হাই স্কুলের অনেক অর্জনের মধ্যে ১৯৭৬ মাত্র একটি

ইংল্যান্ডে দীর্ঘ দেড় যুগ জীবনযাপনের কারণে সেখানকার স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর শিক্ষকদের একটা সর্বব্যাপী প্রভাব দেখা যায়। ভালোকে ভালো বলতে পারা, নৈতিকতার মূল্য বুঝতে শেখা, মানুষকে তার অর্থ-বিত্ত বা পেশার মানদণ্ডে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখা, এমনকি জীবজন্তুর প্রাণের মূল্য বুঝতে পারা—এসব কিছুর মৌলিক শিক্ষাটা ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পরিবারের কাছ থেকে যতটা না পায়, তার চেয়ে অনেক গুণে বেশি পায় শিক্ষকদের কাছ থেকে। মা-বাবার পর সেখানকার বাচ্চারা যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ওপর আস্থা রাখতে পারে, সেই ব্যক্তিটি হন তার শিক্ষক। আমাদের সময়েও আমরা শিক্ষকদের ওপর অনেক আস্থাবান ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের দেশে এখন শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এই আস্থায় অনেকটাই চিড় ধরেছে। তার কারণ হয়তো অনেক—কিছু আর্থসামাজিক বাস্তবতা আর কিছুটা রাজনৈতিক পরিবেশ। এখন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পর্কটা অনেকটা ভোক্তা ও বিক্রেতার সম্পর্ক—শিক্ষক নোট দেবেন, তা মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া যাবে। যত ভালো নোট, তা তত দামি। এর পাশাপাশি আছে শিক্ষক রাজনীতি বা রাজনীতিতে শিক্ষকদের সরাসরি জড়িত হওয়ার প্রভাব।
সৌভাগ্যক্রমে, আমাদের সময়ে এ দুটির কোনোটিই আমাদের নজরে পড়েনি। আমার পরের প্রজন্মের যারা সেন্ট জোসেফসে পড়াশোনা করেছে, তাদের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছিল বলে শুনিনি। তবে, যেহেতু কোনো স্কুলই সমাজবিচ্ছিন্ন নয়, সেহেতু এসব সংকীর্ণ দলাদলি ও রাজনীতির প্রভাব থেকে দীর্ঘ সময় মুক্ত থাকতে পারার চ্যালেঞ্জটা জোসেফস স্কুলের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমার বিশ্বাস, এত দিনের ঐতিহ্য নিশ্চয়ই কেউ হারাতে চাইবেন না এবং শতবর্ষপূর্তিতেও তা সগৌরবে সমুন্নত থাকবে।
আমার স্কুলের বার্ষিক প্রকাশনা ‘জ্যোতি’র গোড়ার দিকের একটি সংস্করণের কপি বছর কয়েক আগে ইন্টারনেটে আমার নজরে আসে। সেটি পড়ে চল্লিশের দশকের গোড়ায় খুলনার যে বিবরণ পাই, তার সঙ্গে আজকের খুলনার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভৌগোলিক অনুষঙ্গগুলোর কিছু মিল হয়তো এখনো আছে, যেমন ভৈরব আর রূপসা নদী। কিন্তু জনপদ বদলে গেছে। গত সাড়ে সাত দশকে প্রতিষ্ঠা হয়েছে নানা ধরনের শিল্প এবং তার অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সে সময়ে যোগাযোগের ঘনিষ্ঠতা ছিল কলকাতার সঙ্গে। আর এখন ঢাকা এবং তারপর যদি বিদেশের কোথাও ভাবি, সেটা হতে পারে নিউইয়র্ক অথবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো শহর। আবার এদের অনেকেই জোসেফস স্কুলের ছাত্র। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জোসেফিয়ানরা (প্রাক্তন ছাত্ররা যে নামে পরিচিত) নিজ নিজ পেশায় সমুজ্জ্বল। সেন্ট জোসেফসের প্লাটিনাম জয়ন্তীতে তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের এই গৌরবের অংশীদার ভাবছেন।
সারা বিশ্বেই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের (অ্যালামনাস) নিয়ে অ্যালামনি সংগঠিত করে থাকে। সেটির কোনো সাংগঠনিক রূপ থাকুক আর না থাকুক। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান অন্বেষণের সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ। এ জন্য প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা দিতে উৎসাহিতও করা হয়। নতুন নতুন শিক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেন্ট জোসেফসও তার অ্যালামনিদের নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে শামিল করতে পারে। ৭৫ বছর পূর্ণ করা জোসেফস স্কুলের এখনো অনেক কাজ বাকি। তার জন্য তাই শুভকামনা।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।