গণতন্ত্রহীনতা, ক্ষমতার দাপট ও মুরাদ হাসানের দম্ভ

প্রতিমন্ত্রী পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া ডা. মুরাদ হাসান যেভাবে নারীকে অবমাননা করে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার গভীর সম্পর্ক আছে। রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের কথা সবাই বলেন, কিন্তু যেটা কেউ সচরাচর বলেন না তা হলো, সমাজে এমনকি পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে কীভাবে গণতান্ত্রিক আচরণ মানুষের মধ্যে প্রোথিত হবে। সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক আচরণ প্রোথিত হয়, ততক্ষণ রাষ্ট্রে যান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা নিরর্থক। মনিব কর্মচারীর সঙ্গে, গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী পরিচারিকার সঙ্গে, ঊর্ধ্বতন অধস্তনের সঙ্গে, উচ্চবর্গের মানুষ নিম্নবর্গের সঙ্গে, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে, তার সবই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচায়ক।

গণতন্ত্র শুধুই একটি রাজনৈতিক উপাদান নয়, একটি সংস্কৃতিও বটে। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিরাজ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রকাশ পেতে থাকে। সাধারণত গণতন্ত্রের রাজনৈতিক উপাদানের বিষয়েই মানুষ বেশি ওয়াকিবহাল। যেমন ভোটের অধিকার, পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার, কথা বলার অধিকার, নিজের মতো করে জীবনযাপনের অধিকার, আয়–উপার্জনের অধিকার ইত্যাদি।

গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্পর্ক নিয়ে, আর গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে অর্থনীতিতে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। যেখানে মূল বক্তব্য হিসেবে আমরা পাই, গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন তথা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া যায় না। সেটিই একটি দেশের মাথাপিছু আয় বাড়াতে সাহায্য করে। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। তার মানে হলো, বাংলাদেশ কয়েক দশক ধরে প্রবৃদ্ধির যে হার অর্জন করছে, তা ধরে রাখতে পারবে না, যদি দীর্ঘদিন দেশ গণতন্ত্রহীন থাকে। কারণ হলো, এখানে ক্ষমতাবলয়ের বাইরের লোকেরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সবার অংশগ্রহণে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ ছাড়া দেশ কখনোই উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছাতে পারে না।

গণতন্ত্রের মূল কথা হলো, অ্যাকাউন্টেবিলিটি তথা জবাবদিহি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ভোটের মাধ্যমেই সংসদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তো এগুলো ছিল বিরোধী দলের অংশগ্রহণবিহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচন। বাংলাদেশ যখন প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে, তখন লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের প্রফেসর ডেভিড লুই তাঁর ‘বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকনোমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি’ গ্রন্থে বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থার সুফল বাংলাদেশে অনুপস্থিত। প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলেও দুর্নীতির সূচকে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তার মানে হলো, যেটাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে হচ্ছে, এটা আসলে গণতন্ত্র নয়, অর্থাৎ ডেভিড লুই-এর বক্তব্যই যথার্থ। কারণ, গণতন্ত্রের মূল কথা হলো জবাবদিহি। একজন সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জবাবদিহির পরিবর্তে টাকা বানানো দিকে মনোনিবেশ করেন। কারণ, টাকা হলেই তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন ও ভোট কিনতে পারবেন। দুর্নীতি করলে যেহেতু শাস্তি হয় না, তার জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা বানানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে তিনি মনে করেন। ভোটারবিহীন নির্বাচন বা সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন—দুই ক্ষেত্রেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন, এই মনস্তত্ত্ব দ্বারাই সাংসদরা তাড়িত।

আমার শাস্তি হবে না, আমি আবার নির্বাচিত হব, এমনকি মন্ত্রীও হতে পারব—এমন ভাবনা থেকেই নারীর প্রতি, ক্ষমতাহীনের প্রতি এ রকম দাম্ভিক ও অশালীন আচরণে তাড়িত হন ক্ষমতাবানেরা। নারীর প্রতি এমন অশালীন মন্তব্য ও স্বেচ্ছাচারের কারণটা বোঝা দরকার। নারী স্বভাবতই পুরুষের চেয়ে বেশি ভালনারাবল তথা দুর্বল ও নাজুক (বস্তুত, পশ্চাৎপদ এই সমাজই তাঁকে দুর্বল করে রেখেছে)। তার চেয়েও বড় কথা, আত্মসম্মান হারানোর ভয় তাঁকে তাড়িত করে, কারণ, সমাজে ভিকটিম-ব্লেইমিংয়ের শিকার হন তিনি। সে জন্যই চরমভাবে নিগৃহীত হওয়ার পরও তিনি বিচারের দ্বারস্থ হন না। দ্বিতীয় কারণ, তিনি জানেন, এত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিচার করার কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই, ভিকটিমও যদি ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর কেউ না হন।

‘রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ নয়’—মুরাদ হাসানের শাস্তি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এ-কথা বলেন, তখন ‘এ দেশে ক্ষমতাধরের বিচার হয় না’—এ কথাই সত্যি প্রতিভাত হয়। যিনি একজন প্রতিমন্ত্রী হয়ে একজন নারীকে ধর্ষণ করার হুমকি দিচ্ছেন, গুলি করার হুমকি দিচ্ছেন, অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ‘রাষ্ট্র সংক্ষুব্ধ নয়’। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার নাম ব্যবহার করে সেই নারীকে হুমকিও দিয়েছেন মুরাদ হাসান। এর মাধ্যমে সংস্থাগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। এ কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ।

মুরাদ হাসানের এই অন্যায় আচরণ, অশালীন ভাষা প্রয়োগ, হুমকি—সবই একটি গণতন্ত্রহীন দেশের ক্ষমতাবানের প্রতীক। যার কারণ ওপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সুন্দরভাবে। এগুলো গণতন্ত্রহীনতার উপসর্গ বলেই ব্যাখ্যা করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের যাত্রা করতে হবে গণতন্ত্রের দিকেই।

এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
[email protected]