বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদ্যাপিত হচ্ছে। এ উদ্যাপনের প্রতিপালক হলো বাংলাদেশ সরকার। অনেক আয়োজন, অনেক আলো। আকাশে অনেক প্লেন উড়ছে। কিন্তু একজনকে আজ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তার নাম গণতন্ত্র, তার নাম ভোটাধিকার। ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আমরা বারবার পেয়েও হারাই। গণতন্ত্র আজও মুক্তি পায়নি।
সত্তরের নির্বাচন ছাড়া কি মুক্তিসংগ্রামকে কল্পনা করা যায়? ওই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি ওই নির্বাচনে তাদের সর্বোত্তম নেতা নির্বাচন করে। জনগণের এই বিপুল সম্মতি ছাড়া স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবের চূড়ান্ত দাবিনামা পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রকে বেকায়দায় ফেলতে পারত না। ওই নির্বাচনের গণরায়ই স্বাধীনতার সব ঘোষণার ভিত্তি। এ গণরায়ই মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এর ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অবিসংবাদী নেতা। এর ভিত্তিতেই মেজর জিয়া সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দিতে পারেন, এর ভিত্তিতেই তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের কাছে গণতান্ত্রিকভাবে গঠিত সরকারের স্বীকৃতি পায়।
সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র হলো মানিকজোড়। একটি না থাকলে আরেকটি হতো না। একটিকে ছাড়া আরেকটি চলতেও পারে না। এটা হলো দিনের আলো আর সূর্যের সম্পর্কের মতো। সূর্য নেই, কিন্তু দিনের আলো আছে, সেটা অবাস্তব।
আধুনিক বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই চমকপ্রদ ঘটনা আচানকভাবে হয়নি। গণতন্ত্র যে মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হবে, তা নিশ্চয় শেরেবাংলা ফজলুল হক বা সোহরাওয়ার্দী অনুমান করেননি। কিন্তু গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে তারা গণ-আন্দোলনের যে চাকা গড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ মুজিবের হাতে, তা স্বাধীনতার বাহনে পরিণত হয়। আর হ্যাঁ, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি তো শোষণের বিরুদ্ধেই চাওয়া হয়ে থাকে। ১৯২০-৩০ দশকে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল মূলত কৃষক। তাঁদের ওপর ছিল অল্প কিছু জোতদার। কিন্তু শোষণটা চলত জমিদারদের মাধ্যমে। বাকি সবাই ছিল তাঁদের প্রজা। এই জমিদারেরাই আইন, তাঁরাই মালিক। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল মূলত তাঁদেরই দল। তখনো মুসলিম লীগ তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি।
সুতরাং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র হলো মানিকজোড়। একটি না থাকলে আরেকটি হতো না। একটিকে ছাড়া আরেকটি চলতেও পারে না। এটা হলো দিনের আলো আর সূর্যের সম্পর্কের মতো। সূর্য নেই, কিন্তু দিনের আলো আছে, সেটা অবাস্তব।
জমিদারি শোষণ আর মহাজনি লুণ্ঠনে খুব করুণ বাংলার কৃষকের অবস্থা। তাঁদের ঠেকানোর কেউ ছিল না। যেহেতু জমিদারদের মাধ্যমেই বাংলার রাজস্ব শোষণ করত ব্রিটেন, সেহেতু তারা ছিল এর পাহারাদার। সে আমলে সবার ভোটাধিকারও ছিল না। অনেক সংগ্রামের পর ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে চার আনা খাজনা দিয়েছেন, এমন মধ্য কৃষকেরা ভোটাধিকার পেলেন। এর মধ্যে জনগণের ভেতর থেকে উঠে এলেন একজন আইনজীবী এ কে এম ফজলুল হক। তিনি কৃষক প্রজা পার্টি খুললেন। ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় কৃষক প্রজা পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী ইশতেহারে জমিদারি-মহাজনি ফাঁস আলগা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইতিহাস দেখল আবাবিল পাখিরা জেগে উঠেছে। দলে দলে ভোটাররা জীবনের প্রথমবার পাওয়া সুযোগে বাংলা থেকে জমিদারি-মহাজনি প্রার্থীদের পূর্ব বাংলা থেকে মোটামুটি উড়িয়ে দিল আর হক সাহেবের নাম হলো শেরেবাংলা।
জমিদার-মহাজন গেল বটে, কিন্তু চেপে বসল পাঞ্জাবিদের শাসন। বাংলার আবাবিলেরা তাদের জবাব দিয়ে দিল সত্তরের নির্বাচনে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন যদি সমাজসংস্কারের শক্তি জোগায়, ১৯৭০-এর নির্বাচন জোগায় স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের আত্মবিশ্বাস। এ নির্বাচন জাতিকে প্রস্তুত করেছিল একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের। ১৯৯১-এর নির্বাচনেও আবাবিলদের কারুকাজ দেখা গেল। তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অধিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশর অর্থনীতির কপাট খোলায় এ ঘটনার প্রভাব বিরাট।
মুক্তিযুদ্ধে সশরীর লড়াই করেছিল তিন লাখ তরুণ। এখন আমাদের আছে প্রায় তিন কোটি তরুণ ভোটার! সব মিলিয়ে আমাদের আছে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। আমাদের আছে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ আর সংগ্রামী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। আমাদের আছে ১৮ কোটি মানুষ। এত বড় আবাবিল বাহিনীকে ভোটের মাঠ থেকে দূরে রাখা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরাট বরখেলাপ।
এমনকি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদ্যাপনের আয়োজনেও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায় না। একটি দলের মাধ্যমে উৎসব হয় না। উৎসবকে হতে হয় সর্বজনীন। সব দল ও মতের মানুষকে শামিল না করা গেলে তা জাতীয় উৎসব হবে কী করে? আর মানুষ যেখানে সব পক্ষকে দেখতে পায় না, সেখানে তারা সবাই আসেও না।
অবাধ নির্বাচন ছাড়া নেতাও তৈরি হয় না। শেরেবাংলা, মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তো অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমেই জাতির মুখ্য প্রতিনিধির মর্যাদা পেয়েছিলেন। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যে দেশে সমার্থক, সেখানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের উদ্যাপনের আনন্দ জনগণ উপলব্ধি করবে কীভাবে?
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]