গণতন্ত্র নিয়ে সবক দেওয়ার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর তাঁদের নির্বাচন করা ১০৮টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় ছিল গণতন্ত্র সম্মেলন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী ও সংহত করাই ওই সম্মেলনের সাধারণ লক্ষ্য ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটি আপাতবিরোধী (প্যারাডক্সিক্যাল) বিষয় হিসেবে পর্যবসিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্র মুখ্যত হলো সেই রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা নিজের স্বার্থ ও লক্ষ্য পূরণে সব সময়ই তারা ব্যবহার করে থাকে। অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থরক্ষার মধ্যে গণতন্ত্রের যে মূল অর্থ নিহিত, সে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রাধান্য পায় না। দেশটি সব সময় নিজেকে গণতন্ত্রের রোল মডেল এবং সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষক হিসেবে দাবি করে কিন্তু পরিহাসের বিষয়, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে দেশটি আসলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাত্রার কর্তৃত্ববাদী দেশ।

ইতিহাস নিজেই নিজের কথা বলে। ইতিহাস বলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায় করার দরকার হলে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাত দেখিয়ে অন্য দেশে সামরিক হামলা চালানোসহ নৃশংস নির্যাতন করতে কোনো রকম ভাবনাচিন্তা করে না। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার—এ দুটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই দ্বৈতনীতি অনুসরণ করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নিজে বা অন্য কাউকে দিয়ে যেসব দেশে অভিযান চালায়, সেসব দেশে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, দারিদ্র্য এবং অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের এসব কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের মূলনীতির বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখে। অধিকন্তু গণতন্ত্রের মার্কিন সংস্করণ গণতন্ত্রের মূল উপাদানকে, অর্থাৎ জনগণের উল্লেখযোগ্য সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে শুধু পদ্ধতিগত দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করে। পদ্ধতিগত গণতন্ত্র বরাবরই রাজনীতিকদের কারসাজির হাতিয়ার হয়ে আসছে কারণ এ কথিত গণতন্ত্র দেশের নাগরিকদের শুধু ‘ভোটার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং কয়েক বছর পরপর শুধু ভোট দেওয়ার জন্য তাদের দরকার হয়।

ইতিহাস নিজেই নিজের কথা বলে। ইতিহাস বলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায় করার দরকার হলে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাত দেখিয়ে অন্য দেশে সামরিক হামলা চালানোসহ নৃশংস নির্যাতন করতে কোনো রকম ভাবনাচিন্তা করে না।

গণতন্ত্রের মার্কিন সংজ্ঞা অনুসারে, গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং লক্ষ্য হিসেবে জনগণকে স্থান দেওয়া হয় না। জনগণকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত না করে শুধু ভাসা–ভাসাভাবে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে গণতন্ত্রের যে সংকীর্ণ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, তা কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটি দিয়ে সাধারণ নির্বাচনে ভোটার হিসেবে জনগণ শুধু ভোট দিতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে তা গোটা জাতির জন্য সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না।

মার্কিন ধাঁচের গণতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে গভীর দ্বন্দ্ব। প্রকৃত গণতন্ত্রকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের ভরসাস্থল হতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং একটি সুষ্ঠু জীবনই হবে গণতন্ত্রের সারবস্তু। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, মার্কিন প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এমন রাজনীতিবিদদের জন্ম দেয়, যাঁরা নিছক নিজেদের স্বার্থে কথা বলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কারসাজির মাধ্যমে ব্যবহার করে নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রের ভাষ্য তৈরি করে চলেছে। গণতন্ত্রের নামে মার্কিন সরকার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অগণতান্ত্রিক ও অসভ্য কায়দায় হস্তক্ষেপ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, তারা আর গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা নয়। অন্যান্য দেশকে ‘শিক্ষিত’ করার আগে তাঁর নিজের রাজনৈতিক অবক্ষয় রোধ করার চেষ্টা করা উচিত।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • সান জি চীনের বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের নাগরিক ও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের শিক্ষক