গণতন্ত্র হার মানে না

প্রধানমন্ত্রী মের বক্তব্যগুলোর প্রতীকী গুরুত্ব অনেক। হামলার সময় এবং তারপরের যেসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে ওয়েস্টমিনস্টার যে বিভিন্ন জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির এক চমৎকার সম্মিলন কেন্দ্র ছিল, তা সহজেই বোঝা যায়। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন আছে ব্রিটিশ স্কুলছাত্র, তেমনি আছে ফরাসি শিক্ষার্থীরা। আছেন চারজন কোরীয় পর্যটক। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন একজন স্প্যানিশ নারী। আরও আছেন রুমানিয়া, চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানির নাগরিক। পার্লামেন্টের ভেতরে যেসব এমপি ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও জাতিগত বৈচিত্র্য ব্যাপক। আমাদের তিনজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপিও তখন অধিবেশনে ছিলেন। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের দিন। সুতরাং, এমপিদের উপস্থিতিও ছিল বেশি। হামলার সময় সেখানে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার নানা খণ্ডচিত্র আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি। অধিবেশন মুলতবি করে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার এমপিদের অধিবেশনকক্ষেই অবস্থান করতে বলেন। সব মিলিয়ে এমপি, পার্লামেন্টের সব কর্মী, অভ্যাগত অতিথি-দর্শকদের প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পার্লামেন্ট ভবনের বিভিন্ন অংশে অপেক্ষা করতে বলা হয়। পার্লামেন্টের আরেকটি অংশ আছে রাস্তার অপর পারে পোর্টাকিউলিস হাউস। সেখানেও অনেকে আটকা পড়েন। পার্লামেন্টের উল্টো দিকের কয়েকটি ভবনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক সম্পাদক ও প্রতিবেদকদের জন্য আলাদা অফিস রয়েছে। ফলে হামলার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের অনেকেই ছিলেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আমাদের মতো নয়। আমাদের এখানে নিরাপত্তার কথা বলে এমন সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রবেশাধিকার অনেকাংশেই সংরক্ষিত হয়ে আছে। কিন্তু ব্রিটেনে অনেক দিন ধরেই মুক্ত গণতন্ত্র হিসেবে পার্লামেন্টকে সাধারণ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সেখানে যেকোনো নাগরিক তাঁর এমপির সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেন, দর্শক গ্যালারি থেকে অধিবেশন প্রত্যক্ষ করতে পারেন। ছাত্রছাত্রীরা আসেন গণতন্ত্র, সরকারব্যবস্থা—এগুলো সম্পর্কে হাতে-কলমে শিখতে। কমিটির সভাগুলোতে আগ্রহী যে কেউ অনুমতি নিয়ে উপস্থিত থাকতে পারেন। তা ছাড়া ওয়েস্টমিনস্টারের বিভিন্ন কক্ষ এবং ছোটখাটো মিলনায়তন ভাড়াও দেওয়া হয় বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে।

কতবার যে আমি ওয়েস্টমিনস্টারে গিয়েছি তার হিসাব দেওয়া যাবে না। লন্ডনে থাকলে নানা সভা-সমিতির কারণে সেখানে যাওয়া; সুতরাং হামলার খবরটি শোনার পরই নিজের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি-উদ্বেগ তৈরি হয়। ওয়েস্টমিনস্টারের চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে বেষ্টনী অথবা ভারী কংক্রিটের প্রতিবন্ধক বসানো আছে। কংক্রিটের প্রতিবন্ধকগুলো এমনভাবে তৈরি যে তাতে ভারী কোনো ট্রাক দ্রুতগতিতে এসে ধাক্কা মারলেও সেগুলোর কিছুই হবে না। আর বেষ্টনীর ভেতরে প্রবেশের সময় নিরাপত্তাচৌকিতে যে ধরনের তল্লাশি হয়, তা বিমানবন্দরের মতোই। আবার ওয়েস্টমিনস্টার চত্বরে ভিআইপি যানবাহন ঢোকার জন্য যে নির্দিষ্ট ফটক ও পথ, সেখানেও চাইলেই যেকোনো গাড়ি ঢোকানো সহজ নয়। যে টেমস নদীর পাড়ে ওয়েস্টমিনস্টার, সেখানে গেল সপ্তাহান্তে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলার একটি মহড়াও করেছে লন্ডন পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট। সুতরাং, সেখানে জোরালো নিরাপত্তা প্রহরা থাকার কথা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্যার মাইকেল ফ্যালন বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তাঁদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কারণে গত এক বছরে ১২টি হামলা নস্যাৎ করা গেছে। িকন্তু ত্রয়োদশ বার তা ঠেকানো গেল না।

এ রকম একটি জায়গায় শুধু একটি এসইউভি হিসেবে পরিচিত গাড়ি ও রান্নাঘরের ছুরি নিয়ে একজন হামলাকারী কীভাবে হামলা চালাতে পারে, তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আর যদি সে হামলা চালাতে সক্ষমও হয়, তাতেও একজন হামলাকারীর পক্ষে ৪ জনকে হত্যা এবং ৪০ জনকে জখম করার খবর রীতিমতো হতবাক হওয়ারই বিষয়। আই পত্রিকা তাই যথার্থই বলেছে যে ওয়েস্টমিনস্টারের হামলা নতুন ধরনের সন্ত্রাসবাদের দৃষ্টান্ত: নিম্ন প্রযুক্তি, আত্মঘাতী অথবা প্রায়-আত্মঘাতী এবং নির্বিচার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকেই এখন বলছেন, আগে সন্ত্রাসের ধরন ছিল বড় ধরনের হামলা, যার জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন হতো। ফলে গোয়েন্দারা এসব প্রস্তুতির খবর পেয়ে যেতেন এবং তা আগাম ঠেকানো সম্ভব ছিল। কিন্তু এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত বিপথগামী ব্যক্তিবিশেষের বেপরোয়া উন্মাদনা।

হামলার পরদিনের টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছে এমন একটি ছবি, যাতে দেখা যাচ্ছে ওয়েস্টমিনস্টারে গাড়ি ঢোকার প্রধান ফটকটির পর চত্বরের ভেতরের রাস্তায় দুটি দলে পুলিশ এবং জরুরি সেবাকর্মীদের কয়েকজন দুজন আহত ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একটি দল বাঁচাতে চেষ্টা করছে ছুরিকাহত পুলিশ কনস্টেবল কিথ পামারকে এবং অপর দলটি পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া হামলাকারীকে। পরে অবশ্য দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। আইনের শাসনে সন্দেহভাজন অপরাধীকে আদালতের সামনে হাজির করাই যে প্রত্যাশিত। এই ছবির আরও উল্লেখ করার বিষয় ছিল আহত পুলিশ অফিসারের মুখে মুখ ঠেকিয়ে তাঁর জ্ঞান ফেরাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টোবিয়াস এলউডের চেষ্টা। গার্ডিয়ান এবং আই পত্রিকা দুটি অবশ্য শুধু এলউডের ছবিটিকেই তাদের প্রধান ছবি করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে তাঁর সাহস ও মানবিকতা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোর প্রায় সবই এই হামলাকে প্রধানমন্ত্রী মের মতোই গণতন্ত্রের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করেছে। গার্ডিয়ান এবং আই-এর একই শিরোনাম, ‘টেরর ইন ওয়েস্টমিনস্টার’; মিরর বলেছে, ‘অ্যাটাক অন ডেমোক্রেসি’, মেইল লিখেছে, ‘ডে টেরর কেম টু ওয়েস্টমিনস্টার’। আর টেলিগ্রাফ শিরোনাম করেছে, ‘উই উইল নেভার অ্যালাউ ইভিল টু ড্রাইভ আস অ্যাপার্ট’।

গণতন্ত্রের ওপর আঘাত যেন ব্রিটিশ সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি না করে, সে দিকটির ওপরই এখন জোর দিচ্ছে মূলধারার রাজনীতিক এবং গণমাধ্যমগুলো। টেলিগ্রাফ তাই আরও লিখেছে, ‘জিহাদিরা বর্তমানে একটি বাস্তব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তারা আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ করে দিতে চায়। প্রতিক্রিয়া যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে তারা যা চায় সেটা তারা পাবে না।’ টাইমস পত্রিকাও লিখেছে, মুক্ত সমাজে পূর্ণ নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর নিরলস চেষ্টার পাশাপাশি সরকারের নমনীয় পন্থায় ওই আদর্শকে পরাস্ত করতে হবে। আর নাগরিকদের সংযম ঘৃণাকে জয়ী হতে দেবে না। গার্ডিয়ান-এর সাংবাদিক সয়মন জেনকিন্স অবশ্য লিখেছেন, এই হামলা একটি ট্র্যাজেডি, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য শুধু কয়েকজনকে হত্যা করা নয়, বহুমাত্রায় ত্রাস সৃষ্টি করা। এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার মানে দাঁড়াবে তাদের হাতকেই শক্তিশালী করা।

কয়েক দশক ধরে লন্ডনের বিস্ময়কর এক রূপান্তর ঘটে চলেছে। লন্ডন আর রানি ভিক্টোরিয়ার আমলের ইংলিশ রাজধানী নেই। লন্ডনের মতো বহুভাষী, বহুসংস্কৃতি, বহুধর্ম, বহুজাতির মেট্রোপলিটন শহর বিশ্বে এখনো খুব বেশি একটা নেই। শহরের মেয়র একজন মুসলমান। কিন্তু শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তিনি সমকামীদের সম-অধিকারের বিরোধী নন। বুধবারের এই হামলার পর মেয়র সাদিক খান বলেছেন, ‘আমরা সন্ত্রাসীদের বিজয়ী হতে দিতে পারি না। আমরা যে একে অপরকে মেনে নিই, সম্মান করি এবং অন্যের সাফল্য উদ্‌যাপন করি, সেটিকে সন্ত্রাসবাদীরা ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা মাথা নোয়াব না।’ কিন্তু মেয়র সাদিক খানের প্রতি প্রথম চ্যালেঞ্জটা ব্রিটেনের ভেতর থেকে আসেনি, এসেছে আটলান্টিকের অপর পার থেকে। ব্রিটেনের চরম ডানপন্থী বা বর্ণবাদী রাজনীতিক হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা কিছু বলার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র সাদিক খানকে উদ্দেশ করে টুইটারে বিতর্কিত মন্তব্য করে অনলাইনে ঝড় তুলেছেন। সাদিক খান গত বছর দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘যেকোনো বৈশ্বিক শহরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা এখন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ ট্রাম্পপুত্র ওই নিবন্ধ তুলে ধরে লিখেছেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই ভাঁওতাবাজি করছেন?’ ব্রিটিশ নাগরিকেরা অবশ্য ট্রাম্পপুত্রের এই খোঁচানো একেবারেই পছন্দ করেননি। তাঁরা বরং এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনাকে পুঁজি করে মেয়রকে অপদস্থ করার চেষ্টায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছেন।

লন্ডন এর আগেও উগ্র ইসলামপন্থীদের হামলার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছিল ২০০৫ সালের ৭ জুলাই। সেদিন সকালে আমি যখন অফিসমুখী ট্রেনে, তখনই প্রায় একই সময়ে তিনটি জায়গায় টিউব এবং বাসে আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল। সেসব হামলায় ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছিল এবং ৭০০ জনের মতো আহত হয়েছিলেন। শহরজুড়ে আতঙ্কের ছাপ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ইসলামপন্থীদের হামলারও আগে লন্ডনসহ ব্রিটেনের নানা জায়গায় আইরিশ বিদ্রোহীরা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। তবে আইরিশ বিদ্রোহীরা হামলা চালানোর আগে যেখানে তারা বোমা পেতে রাখত, সেখানকার কথা পুলিশকে জানিয়ে দিত, যাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি এড়ানো যায়। তারা ব্রাইটনের একটি হোটেলে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে লক্ষ্য করেও হামলা চালিয়েছিল। সুতরাং, সন্ত্রাস মোকাবিলার বিষয়টি ব্রিটেনের জন্য নতুন নয়। আর লন্ডন যতবারই সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে, ততবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও যে তেমনটি হবে, সন্দেহ নেই। হামলার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই পার্লামেন্ট আবার বসেছে। নাগরিকেরা যার যার কাজে ফিরে গেছেন। সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। উচ্চারিত হচ্ছে ‘আমরা ভীত নই’ স্লোগান।

ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোর কথা আগেই বলেছি। ইউরোপ-আমেরিকার কাগজগুলোর শিরোনামগুলোও দেখেছি। কিন্তু সেগুলোর সব কটিকে ছাড়িয়ে গেছে সৌদি আরবের কাগজ আরব নিউজ। তারা লিখেছে, লন্ডন হ্যাজ নট ফলেন (লন্ডনের পতন ঘটেনি)। গত বছর মুক্তি পাওয়া লন্ডন  হ্যাজ ফলেন চলচ্চিত্রের কথা হয়তো সবার মনে থাকবে। তাতে লন্ডনে ধ্বংসযজ্ঞের িচত্রায়ণ ছিল। চলচ্চিত্র কখনো সত্য হবে না এবং আমরাও বলব, লন্ডন ভীত নয় এবং লন্ডনের পতন হয়নি।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক