গণভোটে সমাধান নেই, আছে সমস্যা

.
.

অনেক দিন ধরেই বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের একটা সংকট চলছে। একাধিক বৈশ্বিক মন্দা, কয়েকটি আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদের বিস্তার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামোতে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। এক দিকে বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকারত্ব, অন্যদিকে নিরাপত্তার নামে নাগরিক অধিকার হয়েছে সংকুচিত। রাজনীতিকদের অনেকে ভেবেছেন, আরও কিছু ভোটের ব্যবস্থা করলেই ওই সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক চারটি গণভোট সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে সংকট আরও জটিল করে দিয়েছে। যাঁরা সুইজারল্যান্ডের গণতন্ত্রের মডেলকে আদর্শ সমাধান মেনেছিলেন, তাঁদের এখন আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে বছরজুড়েই প্রায় প্রতিটি বিষয়ে নাগরিকদের মতামত জানতে গণভোট হয়ে থাকে। কিন্তু গণভোট যে এমনকি সদ্য ম্যান্ডেট নবায়ন করা প্রধানমন্ত্রীকেও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে পারে, তার প্রমাণ গণতন্ত্রের তীর্থকেন্দ্র–খ্যাত ব্রিটেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না–থাকার কথিত ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোটে মাত্র ৪ শতাংশ ভোটের (ইইউ ত্যাগের পক্ষে ৫২%, বিপক্ষে ৪৮%: সূত্র: ইইউ রেফারেন্ডাম: ফুল রেজাল্টস অ্যান্ড অ্যানালাইসিস, দ্য গার্ডিয়ান)  কারণে ডেভিড ক্যামেরন মাত্র আট মাসের মাথায় তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান।

ব্রিটেনের পর আরও তিনটি দেশের গণভোটে যেসব ফলাফল এসেছে, তার কোনোটিই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য সুখকর হয়নি বা ভালো ফল দেয়নি। এগুলোর মধ্যে সর্বসাম্প্রতিক দুটি হচ্ছে কলম্বিয়া ও হাঙ্গেরির। গেল শুক্রবার এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস। কলম্বিয়ায় অর্ধশতকের গৃহযুদ্ধ অবসানে তাঁর যে শান্তিপ্রচেষ্টা, তার স্বীকৃতি হিসেবেই তিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হলেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফার্কের সঙ্গে সম্পাদিত তাঁর শান্তি সমঝোতা গণভোটে দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। ভোটের ব্যবধান মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ—মাত্র ৬০ হাজার। নোবেল কমিটি তার বিবৃতিতে বলেছে যে কলম্বিয়ায় শান্তিপ্রচেষ্টা ‘প্রকৃত বিপদে’ পড়ার মধ্যেও এই পুরস্কার দেওয়ার উদ্দেশ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা। কলম্বিয়ার পাঁচ দশকের গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এবং নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৪৫ হাজার। কলম্বিয়ার নাগরিকেরা জনমত জরিপে শান্তির পক্ষে বললেও ফার্ক গেরিলাদের প্রতি যে অনুকম্পা বা ক্ষমা প্রদর্শনের অঙ্গীকার করা হয়েছে, ভোটে তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে গণভোটে সমাধান যেমন মেলেনি, তেমনি শান্তিপ্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন এখন বহুগুণে কঠিন হয়ে পড়েছে।

২ অক্টোবর যেদিন কলম্বিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, সেদিনই ইউরোপেরও একটি নতুন গণতন্ত্র, হাঙ্গেরিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশটিতে গণতন্ত্রায়ণ শুরু হয় এবং ১২ বছর আগে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পায়। হাঙ্গেরির গণভোটের বিষয় ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া-লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলো যে কোটা ভাগাভাগিতে সম্মত হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করা। হাঙ্গেরি শরণার্থীদের জন্য তার সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে যে গণভোট অনুষ্ঠান করে, তাতে সরকারের প্রস্তাবটি পাস হলেও ভোটের বৈধতার জন্য ভোটারদের যে পরিমাণ অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল, তা পূরণ হয়নি (আইন অনুযায়ী গণভোটে ৫০ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হলেও ভোট পড়ে ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ, সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান)। ফলে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ হলেও তার আইনগত স্বীকৃতিতে ঘাটতি থেকেই গেছে।

চতুর্থ যে গণভোটটির কথা বলা প্রয়োজন, সেটি হয়েছে থাইল্যান্ডে গত আগস্টে। সেখানকার সামরিক জান্তা নতুন একটি সংবিধানের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত করেছে, যার ফল গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর নয়, বরং তাতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা বেড়েছে। জান্তা গণভোটের জন্য যে কৌশল অনুসরণ করে, তা ছিল ভোটারদের ব্ল্যাকমেলিংয়ের শামিল। শর্ত ছিল, সংবিধান অনুমোদন করলেই নির্বাচন হবে, নইলে নয়। ফলে সংবিধানে অগণতান্ত্রিক বিধিবিধান সংযোজিত হলেও ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার আশাতেই ওই গণভোটে প্রস্তাবিত সংবিধান অনুমোদিত হয়। গণভোটের আগে সংবিধানের খসড়া নিয়ে আলোচনা ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং ভিন্নমত বা বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরার সুযোগ প্রায় ছিলই না। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দুই সামরিক শাসকের গণভোট দুটির অভিজ্ঞতা স্মরণ করলেই মিলগুলো পাওয়া যাবে।

ফিরে যাই ব্রিটেনের গণভোট প্রসঙ্গে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্রিটেনে যে ব্যাপক কৃচ্ছ্রতার নীতি অনুসৃত হয়, তাতে একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। সেই চাপা ক্ষোভকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠে সেখানকার চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো। আর্থিক টানাপোড়েন ও কৃচ্ছ্রতার জন্য তারা দায়ী করে অভিবাসন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানা বিধি, রীতি ও​ ব্যয়কে। দলের বাইরে  নাইজেল ফারাজের ইউকিপ (ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি) এবং ভেতরে কট্টর ডানপন্থী অংশের চাপ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন ভেবেছিলেন, গণভোটে তিনি ইইউতে থাকার পক্ষে ম্যান্ডেট আদায়ে সফল হলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় হবে। কিন্তু ভোটের ফল হলো উল্টো। পরিণতিতে শুধু যে মি. ক্যামেরনের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটল তা নয়, বিরোধী দল লেবার পার্টি এবং নাইজেল ফারাজের ইউকিপে অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক তোলপাড় শুরু হলো। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিকতম সংযোজন হচ্ছে ইউকিপের নেতৃত্বের লড়াই বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে হাতাহাতির রূপ নেওয়া এবং মাথায় আঘাতের কারণে সম্ভাব্য নেতা, স্টিভেন উলফের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। নাইজেল ফারাজের বিদায়ের পর দলটিতে যিনি নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই ডিয়ান জেমস মাত্র ১৮ দিনের মাথায় পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার পর নতুন করে শুরু হয় এই গৃহবিবাদ। আর বিরোধী দল লেবার পার্টিতে বামপন্থার উত্থান ঠেকাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি জোটবদ্ধ হয়ে জেরেমি করবিনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও শিগগিরই যে দলের ভেতরে ঐক্য ফিরবে, তেমন আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। এদিকে ব্রেক্সিটের সম্ভাবনায় পাউন্ডের অব্যাহত দরপতনে একধরনের অস্থিরতার জন্ম হয়েছে।

গণভোটকে জনসমর্থনের ভিত্তিতে দেশশাসনের সবচেয়ে ভালো পন্থা বলে মনে করা হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেই এখন বলছেন যে এটি আসলে অর্থহীন। এমনকি, কখনো কখনো বিপজ্জনক। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল মার্শ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন যে এটি একেবারেই ভালো নয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, এলএসইর অর্থনীতির ফেলো আলেকজান্দ্রা কিরোন বলছেন, এই হাতিয়ারটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও রাজনীতিকেরা এটা ব্যবহার করে চলেছেন এই আশায় যে তাঁরা জিতবেন। কিন্তু প্রায়শই তাঁরা বিজয়ী হন না এবং রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে গিয়ে নতুন সংকটের জন্ম দেন। যেকোনো গণভোটেই ভোটাররা যে সমস্যার মুখে পড়েন তা হলো নীতিগত বিষয়ে দুরূহ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তাঁদের শুধু হ্যাঁ অথবা না–এর মধ্যে আটকে থাকতে হয়। অথচ ওই সব নীতিগত সমস্যা সমাধানে বিশেষজ্ঞরা হয়তো বছরের পর বছর গবেষণা করছেন কিংবা বিতর্কে লিপ্ত আছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্থার লুইপা এবং ম্যাথু ডি ম্যাককাবিন্স একে ভোটারদের জন্য ‘শর্টকাটস’ বলে অভিহিত করে বলছেন, এ রকম ক্ষেত্রে ভোটাররা সাধারণত নেতৃস্থানীয় বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। যে ধরনের ব্যাখ্যা শুনে তাঁরা অভ্যস্ত, তাতেও অনেকে প্রভাবিত হন। সরকার বা বিরোধী দলের প্রতি সমর্থন কিংবা নেতা-নেত্রীদের প্রতি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও এ ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। ফলে নীতিগত বিষয়গুলো হয়ে যায় গৌণ। ব্রিটেনের গণভোট এবং ভোট-পরবর্তী রাজনীতিতে এটা সুস্পষ্ট যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো কোনো নীতিতে কী সুবিধা অথবা অসুবিধা তার বিচার-বিশ্লেষণের পরিবর্তে অভিবাসন এবং কথিত সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেই ভোটাররা তাঁদের রায় দিয়েছেন। ফলে ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ধরে রাখা কিংবা ইউরোপের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে ব্রেক্সিট-উত্তর সময়ের বিকল্প নীতির এখনো দেখা মিলছে না।

এবার আসি গণভোট নিয়ে এত কথার প্রাসঙ্গিকতায়। সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশেও একাধিক বিষয়ে গণভোটের দাবি উঠেছে। এর মধ্যে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা উচিত কি না, সেই প্রসঙ্গও আছে। শুক্রবার ঢাকায় ‘শত নাগরিক কমিটি’ নামের একটি গোষ্ঠী এই দাবি করেছে। এর আগে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল, বিএনপির কিছু নেতা বিচ্ছিন্নভাবে দাবি তুলেছিলেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে গণভোট করা হোক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের গণভোট কি সত্যিই কোনো সমাধান দিতে পারে? গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনব্যবস্থাই যেখানে অনুপস্থিত, নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এ ধরনের হাতিয়ার যে নতুন সংকটের জন্ম দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

গণতন্ত্র নিয়েই যেহেতু এই আলোচনা, সেহেতু পাঠকদের জানিয়ে রাখি যে বিশ্বের অত্যন্ত মর্যাদাবান একটি সাময়িকী, ফরেন অ্যাফেয়ার্স তার সাম্প্রতিকতম সংখ্যায় বলছে যে বিশ্বে এখন লৌহমানব/মানবীদের শাসন বাড়ছে। চীন কিংবা রাশিয়া—যেখানে আগে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি ছোট বলয় (যেমন পলিটব্যুরো) ছিল, যারা মিলেমিশে ক্ষমতা প্রয়োগ করত, সেখানে এখন সব ক্ষমতা এককভাবে একজন নেতার হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে এখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘চেয়ারম্যান অব এভরিথিং’ নামে। কথিত স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে ১৯৮৮ সালে  এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল ২৩ শতাংশ দেশে। আর এখন তা ৪০ শতাংশ। শুধু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, তুরস্কের এরদোয়ান, বলিভিয়ার এভো মোরালেস কিংবা ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর মধ্যেই এখন তা আর সীমিত নয়, যুক্ত হচ্ছে আরও অনেক দেশের নাম।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।