গাড়ির স্টিয়ারিং যখন নারীর হাতে

সম্প্রতি সৌদি আরবের নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত হওয়ার ঠিক পরপর প্রথম আলোয় ‘চালাও গাড়ি সৌদি নারী’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কয়েকজন পাঠক বাংলাদেশে নারী গাড়িচালকদের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করেন। বিষয়টি সত্যিই ভেবে দেখার মতো। বাংলাদেশে গাড়ি চালনোর ক্ষেত্রে নারীর জন্য কোনো বিধিনিষেধ নেই। গাড়ি চালনার জন্য বাংলাদেশি নারীদের সৌদি আরবের নারীদের মতো কোনো আন্দোলন করতে হয়নি। কিন্তু আজও চালকের আসনটি বাংলাদেশি নারীদের জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও গাড়ি চালনার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা মোট চালকের ১ শতাংশেরও নিচে।

চালকের আসনে নারীর অবস্থান সব সময়ই আমাকে আশাবাদী করে। মনে পড়ে প্রায় আট বছর আগে শখের বশে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছিলাম আমি। গাড়ি চালানোর চেষ্টাও করেছি কদিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি চালানোর সাহস আর হয়ে ওঠেনি। কারণটি গাড়ি চালানোর দক্ষতার সমস্যা বা সংকটের বিষয় ছিল না; বরং এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আরও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা। তাই যেসব নারী রাস্তায় গাড়ি চালান, তাঁদের খুব সমীহের চোখে দেখি আমি। চালকের আসনে বসে তাঁরা যে শুধু গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে তুলে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়; বরং তাঁরা একই সঙ্গে ঘোষণা করেছেন পারিপার্শ্বিক সব সংকীর্ণতা আর সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে তাঁদের অনমনীয় অবস্থান।

বেশ কয়েক বছর আগে কোনো এক ড্রাইভিং স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছিলেন নারী গাড়িচালক নিয়ে তাঁর উচ্চাশার কথা। তিনি
বলেছিলেন, নারী গাড়িচালকদের মাথা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা। ট্রাফিক সিগন্যাল ও রাস্তার নিয়মকানুনের প্রতি তাঁরা বেশি শ্রদ্ধাশীল এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি তাঁদের
আসক্তি কম। তাই তাঁরা কম দুর্ঘটনা ঘটান। এতগুলো গুণের সন্নিবেশ থাকার পরও কেন নারীরা আরও ব্যাপক হারে এই পেশায় আসছেন না, তা নিয়ে সরকার কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছে?

গাড়ির চালকের আসনে নারীর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই সমাজ আজও চালকের আসনে নারীকে দেখে অভ্যস্ত নয়। নারী গাড়িচালকের পেছনে বসে আমি প্রায়ই প্রত্যক্ষ করি তাঁকে কেন্দ্র করে কৌতূহলভরা মানুষের দৃষ্টি। কোনো নারী বাইকচালকের পেছনে বসে পুরুষের যাত্রা আজও মানুষের মনে হাসির খোরাক জোগায়। খোদ ঢাকা শহরের চিত্রই যদি এমন হয়, তবে ঢাকার বাইরের চিত্রটি নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি ভয়াবহ। নানা ধরনের কটু মন্তব্য উপেক্ষা করে সামনে এগোলেও উপেক্ষা করা যায় না নারী গাড়িচালকের
নিরাপত্তার বিষয়টি।

কয়েক বছর ধরে নারী গাড়িচালক নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে ব্র্যাক এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অগ্রণী
ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ক্ষেত্রে সরকারও তার সদিচ্ছার কথা জানিয়েছে। সরকার যদিও নারী গাড়িচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কোটার বিষয়টি বলে আসছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই, এই কোটা পূরণের জন্য নারী গাড়িচালকের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। ২০১২ সাল থেকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ব্র্যাক নারী গাড়িচালক
উন্নয়নের কাজটি করে আসছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা
যায় সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী চালকের নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিচ্ছুক অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়েও
রয়েছে অনীহা।

এ ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি প্রায়ই প্রধান হয়ে ওঠে। ঢাকার বাইরে দূরবর্তী স্থানে নারী চালককে পাঠানো, খুব সকালে কিংবা গভীর রাতে গ্যাস নিতে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন অনেকেই। এ ছাড়া রয়েছে দায়িত্ব পালনকালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার মতো উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, স্যানিটেশনব্যবস্থার অপ্রতুলতা ইত্যাদি। ব্যক্তিপর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হলো নারীর জন্য পৃথক বিশ্রামকক্ষ ও শৌচাগার না থাকা, মাসিক ঋতুচক্রের বিষয়টি বিবেচনায় না আনা ইত্যাদি। অনেকে আবার নারী চালককে ঘর-গৃহস্থালির কাজেও নিয়োজিত করেন, যা খুবই দুঃখজনক। একটি বিষয় উল্লেখ্য, এই সমস্যাগুলোর কোনোটিই কিন্তু নারীর সৃষ্ট নয়। কিন্তু এর দায় নারীকেই নিতে হয় এবং বিষয়গুলোকে এই পেশায় নারীর সীমাবদ্ধতা বলে বিবেচনা করা হয়।

চালকের আসনে নারী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতাগুলো মোকাবিলা করতে হবে সমন্বিতভাবে। বিআরটিসি ২০০২ সাল থেকে মহিলা বাস সার্ভিস চালু করলেও আজ পর্যন্ত কোনো বাসে নিয়োগ করা হয়নি নারী চালক। এমনকি বেসরকারি উদ্যোগে আসা দোলনচাঁপা মহিলা বাস সার্ভিসেও নেই নারী চালক। তবে আশার কথা, সম্প্রতি বিআরটিসি নারী বাসচালক নিয়োগে উদ্যোগী হয়েছে। তাদের এ উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়িত হলে হয়তো আরও অনেকে নারী চালক নিয়োগে উৎসাহিত হবেন। অনেক প্রতিষ্ঠান অনায়াসে নবাগত নারী চালকদের জন্য ইন্টার্নশিপ ড্রাইভিং বিষয়টি চালু করতে পারে। নারী গাড়িচালক নিয়োগ ও তার স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন নারীর জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

গাড়ি চালনা যে নারীর জন্য কোনো অসম্মানজনক কাজ নয়, এটি প্রতিষ্ঠা করাও অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য চাই পরিবার ও সমাজের সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। নতুবা গাড়ি চালানোর অধিকার এবং সব যোগ্যতা থাকার পরও প্রকৃত অর্থে নারীর হাতে গাড়ির চাকা সচল হবে না। আর নারীও গাড়ি চালিয়ে সচল করতে পারবেন না তাঁর পরিবারের অর্থনীতির চাকা।

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক