গ্লাস ও পানি নিয়ে আর কী বলা যেত...

একটা গ্লাস হাতে একজন শিক্ষক দাঁড়ালেন ছাত্রদের সামনে। ‘দেখো, আমার হাতে একটা গ্লাস। আর এই জগে আছে পানি।’
ছাত্ররা উসখুস করতে লাগল।
‘কী হলো?’
‘স্যার, আমরা জানি আপনি কী বলবেন।’
‘কী বলব?’
একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি অর্ধেকটা খালি আর অর্ধেকটা ভরার গল্প বলবেন। হতাশাবাদী আর আশাবাদীর গল্প।’
স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তা বলতে পারতাম বটে। কিন্তু আমি তা বলব না।’

তখন আরেকজন ছাত্র দাঁড়াল। সে বলল, ‘স্যার, আপনি মানসিক চাপের উদাহরণ দেবেন। বলবেন, এই গ্লাস হাতে আমি যদি পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে এটাকে তেমন ভারী মনে হবে না। কিন্তু আমি যদি পাঁচ ঘণ্টা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে আমার হাত ধরে আসবে, হাত অবশ হয়ে যাবে। স্ট্রেস বা মানসিক চাপও সেই রকম। পাঁচ মিনিট মনে রাখলে চাপ পড়ে না, সারা দিন বয়ে বেড়ালে চাপ বাড়ে।’
‘বাহ্। তুমি খুব ভালো বলেছ। কিন্তু আমি এটাও বলব না।’ শিক্ষক বললেন।
এবার আরেকজন দাঁড়াল। সে বলল, ‘স্যার, আপনি ওই পরীক্ষাটা করবেন।’
‘কোনটা?’

‘আপনি প্রথমে গ্লাসে পাথর ভরবেন। তারপর বলবেন, এটা কি পূর্ণ হয়েছে? আমরা বলব, হ্যাঁ। এরপর আপনি এর ভেতরে ছোট ছোট নুড়ি ঢালবেন। আবার গ্লাসটা পূর্ণ দেখাবে। আপনি তারপর এর মধ্যে বালি ভরবেন। তারপর আপনি এর মধ্যে পানি ঢালবেন। আপনি বলবেন, “এ থেকে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস শিখব। এই যে পাত্রটা দেখছ, এটা হলো আমাদের জীবন। এই যে বড় বড় পাথরখণ্ড, এগুলো হলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আমাদের পরিবার, বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের শিক্ষা। আর নুড়িগুলো হলো আমাদের বিষয়সম্পত্তি, আমাদের গাড়ি-বাড়ি, আমাদের টেলিভিশন, আমাদের টেলিফোন, আমাদের বাগান। আর বালু হলো বাকি সবকিছু, আমাদের জীবনে আর যা যা করতে হয়। প্রথমেই যদি আমরা ছোট ছোট জিনিস দিয়ে জীবনটাকে ভরে ফেলি, তাহলে বড় কাজগুলো করা হবে না। কাজেই সব সময় পরিবারকে সময় দেবে, বাবা-মায়ের যত্ন নেবে, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখবে, লেখাপড়া করবে। তারপর গাড়ি-বাড়ি, কম্পিউটার-টেলিফোন এসবের দিকে নজর দেবে।’’

তারপর আপনি বলবেন, “আর পানি হলো আনন্দ। মানুষের জন্য কিছু করা। সেবার ব্রত। তুমি যা-ই করো না কেন, জীবন আনন্দময়। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য সর্বদাই কিছু না কিছু করার সময় তুমি বের করতে পারবে। মানুষের উপকারে আসতে পারবে। তাতেও তুমি অনেক আনন্দ পাবে। জীবনটাকে যত আঁটসাঁট মনে হোক না কেন, যতই তুমি ব্যস্ত থাকো না কেন, জীবনকে উপভোগ করো। আর যেন সবচেয়ে ভালোভাবে জীবনটাকে আনন্দপূর্ণ করে তোলা যায়, অপরের মুখে হাসি ফোটানোর মাধ্যমে।’”
স্যার হেসে ফেললেন, ‘তোমরা দেখি সবই জানো।’
সবাই বলল, ‘জি স্যার।’

স্যার বললেন, ‘আমি তাহলে নতুন কী করতে পারি। আচ্ছা এই যে দেখছ, এই গ্লাসটা খালি। কিন্তু এটা কি আসলে খালি? না। এর ভেতরে আসলে বাতাস আছে। এখন আমি এর অর্ধেকটায় পানি ভরলাম। আশাবাদীরা বলবে, অর্ধেক ভরা। হতাশাবাদীরা বলবে, অর্ধেক খালি। আর আমরা বলব, এর অর্ধেকটায় আছে পানি, আর অর্ধেকটায় আছে বাতাস। এবার আমি গ্লাসের পানিতে এক চামচ চিনি দিলাম। কী বুঝলাম? এটা আর পানি রইল না। হয়ে গেল শরবত। এবার এক চিমটি লবণ দিলাম। এবার একটা হয়ে গেল খাবার স্যালাইন।

কাজেই খালি চোখে যা দেখা যায়, তার সবটা সত্য নয়। কিন্তু আমি এবার যা করব, তা হলো এক গ্লাস পানিতে একটা ডিম ছেড়ে দেব। দেখো, ডিমটা ডুবে গেছে। কিন্তু পানিতে লবণ কিংবা চিনি মিশিয়ে একই ডিম ছেড়ে দিলে দেখো, ডিমটা ভাসছে। এটা হলো প্লবতার পরীক্ষা। তরলের আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়ল বলে ডিমটা ভেসে উঠল। এবার আমি গ্লাসভরা পানি নিয়ে মুখে একটা কাগজ দিলাম। এবার গ্লাসটা উল্টে দিলাম। হাত ছেড়ে দিলাম। দেখো, কাগজটা পড়ছে না, পানি পড়ছে না। এটা হচ্ছে বাতাসের ঊর্ধ্ব চাপের কারণে। আমার ক্লাস আজকের মতো শেষ। আজকের ক্লাস থেকে আমরা কী শিখলাম?’
একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা কোনো কিছুর শুরু দেখেই ধরে নিই শেষটা কী হবে, কিন্তু সব সময় শেষটা এক রকম না-ও হতে পারে।’
‘আচ্ছা, এবার আরও দুটো কথা বলি। পানির অপর নাম কী?’
‘জীবন,’ ছাত্ররা বলল।
‘কিন্তু তোমরা কি জানো, কেউ যদি ২০-৩০ জগ পানি খায়, কী হবে?’
‘না স্যার।’

‘সে মারা যাবে। এর দ্বারা আমরা কী বুঝলাম? সবকিছুই করতে হয় পরিমিতভাবে। অতিরিক্ত পানি খেলেও মানুষ মারা যাবে। অতিরিক্ত কিছুই করা যাবে না, না ফেসবুক, না খাওয়াদাওয়া। সবকিছুই করতে হবে পরিমিত। আর বায়েজিদ বোস্তামীকে তাঁর মা বলেছিলেন এক গ্লাস পানি আনতে। বালক বায়েজিদ বোস্তামী পানি এনে দেখলেন, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বায়েজিদ বোস্তামী সারা রাত মায়ের শিয়রের কাছে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মাকে ভালোবাসবে। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষা। তিন মাকেই আমরা সবাই ভালোবাসব। আজকের মতো এখানেই শেষ।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক