চট্টগ্রামের শতবর্ষী গ্রন্থাগারটি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

নতুন ভবনে সংকুচিত পরিসরে চট্টগ্রামের শতবর্ষী গ্রন্থাগার
ছবি: জুয়েল শীল

পরিকল্পনা ও পরিণামহীন উন্নয়নের বলি হয়েছে চট্টগ্রামের অনেক ঐতিহ্য। যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা-ও ধ্বংস করার এক অশুভ প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের লালদীঘিপাড়ে অবস্থিত শতাব্দীপ্রাচীন একটি গ্রন্থাগারও এখন ঐতিহ্যখেকোদের কবলে পড়েছে। এই গ্রন্থাগারের মালিক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, বর্তমানে কর্তৃপক্ষ এই গ্রন্থাগারের পরিসর ছোট করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই খবর চট্টগ্রামের পাঠক, লেখক ও ঐতিহ্যপ্রেমীদের খুবই হতাশ করেছে।

জড়িয়ে আছে শতবর্ষের ইতিহাস
১৯০৪ সালে এই গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু। তখন থেকে গত ১১৭ বছরে এ দেশের ইতিহাসে কতশত বাঁকবদল হয়েছে, ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান হয়েছে, পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, মিউনিসিপ্যাল থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়েছে, কার্যক্রম বেড়েছে, পরিধি বেড়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। সেই অনুপাতে গ্রন্থাগারের পরিসর বাড়ারই কথা, সেখানে ছোট করার পরিকল্পনা কেন হচ্ছে, তা কারও বোধগম্য নয়। চট্টগ্রাম নগরের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই গ্রন্থাগার ঔপনিবেশিক সময়ের অনেক স্মৃতিবিজড়িত। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটির যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ভবনে। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের সঙ্গেও এই ভবন যুক্ত। সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল এটিকে সংরক্ষণ করা। তা না করে এখানকার গ্রন্থাগারটি সংকুচিত করার পরিকল্পনা হচ্ছে।

বিংশ শতকের শুরুতে গ্রন্থাগার হিসেবে চালু করার বহু আগে ১৮৫৮ সালে ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। তখন এটি ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়। ১৮৬৩ সালের ২২ জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠিত হয়। ভবনটি সেটির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কমিটির প্রথম প্রশাসক নিযুক্ত হন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে ডি ওয়ার্ড। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটি ১৯০৪ সালে আন্দরকিল্লায় স্থানান্তরিত হলে সেখানে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বর্তমানের চসিক পাবলিক লাইব্রেরি। ভবনটির নিচতলায় ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি। পুরো ভবনটি নগরবাসীর কাছে চসিক পাবলিক লাইব্রেরি নামেই পরিচিত। একসময় সেখানকার ছাদের একটি অংশে সিটি করপোরেশনের ক্রীড়া দলেরও কাজ শুরু হয়।

গ্রন্থাগার ভবনে গ্রন্থাকারই যখন গুরুত্বহীন
২০১৭ সালে আধুনিকীকরণের জন্য ব্রিটিশ আমলের ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে গড়ে ওঠে নতুন ৮ তলা ভবন। নতুন ভবন নির্মাণকালে পুরোনো ভবনটির হাজার হাজার দুর্লভ বই বিবিরহাটের একটি অফিসে বস্তাবন্দী ছিল। নতুন ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের আমলে ভবনের ৫ ও ৬ তলা লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ দেয়। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি এটি উদ্বোধন করেন। নতুন ভবনে লাইব্রেরির উদ্বোধনের পর দেখা গেল, এখানে প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন মাত্র ৪ হাজার বর্গফুট। অথচ আগের একটি ফ্লোর ছিল ৮ হাজার ২০০ বর্গফুট। সব মিলিয়ে দুই ফ্লোরে বই সংরক্ষণের জন্য আগের চেয়ে জায়গা কমে গেল।

পুরোনো ভবন ভেঙে করা হয় নতুন ভবন। যেখানে আগের চেয়েও পরিসর ছোট হয়ে আসে গ্রন্থাগারটির
ছবি: জুয়েল শীল

আট তলা ভবনটির নিচতলা গাড়ি পার্কিং, দোতলা সম্মেলনকক্ষ, তিনতলা সাইক্লোন শেল্টার, চারতলা শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পাঁচ ও ছয়তলা লাইব্রেরি, সাততলা ক্রীড়া একাদশের কার্যালয় ও আটতলা রেস্টহাউস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর দুটি তলা এখন সিটি করপোরেশনের আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রন্থাগারের গুরুত্ব যদি সিটি করপোরেশন বুঝতে পারত, তাহলে এই ভবনের এ রকম বহুমুখী ব্যবহার তারা হতে দিত না। লাইব্রেরি ভবনে যেন লাইব্রেরিটাই গৌণ হয়ে গেল। আসলে এটি শুধু একটি লাইব্রেরি নয়, এটি একটি সংরক্ষণাগার। এর বর্তমান বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এখানে রয়েছে বহুকালের পুরোনো চিত্রকর্ম, বই, গেজেট সাময়িকী, যা দেশের অন্য কোনো লাইব্রেরিতে নেই। ইতিহাসের কত দলিল এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

দীর্ঘদিন ধরে জনবল সংকট
করপোরেশন লাইব্রেরিটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না অনেক দিন থেকে। এর প্রয়োজনীয়তা তাদের কাছে ফুরিয়ে গেছে যেন। কয়েক বছর ধরে এই লাইব্রেরির প্রতি প্রতিষ্ঠানটি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। এখন যে কেউ একবার লাইব্রেরি পরিদর্শন করলেই দেখবেন এর দুরবস্থা। বইগুলো গাদাগাদি করে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে এই লাইব্রেরির কোনো স্থায়ী গ্রন্থাগারিক নেই। গত বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি নতুন ভবনের উদ্বোধনের পর লাইব্রেরিটি ক্যাটালগ অনুসারে সাজানোর জন্য করপোরেশনের সাবেক গণসংযোগ কর্মকর্তা ও লাইব্রেরিয়ান সাইফুদ্দিন আহমদকে দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম। তিনি সবকিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। লাইব্রেরির আকর্ষণ বাড়াতে তিনি চট্টগ্রামের মনীষীদের জীবন, কর্ম ও ছবি দিয়ে একটি চমৎকার গ্যালারি করেছিলেন। তারপর থেকে আর কোনো লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ পাননি। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, লাইব্রেরির পুরোনো বইয়ের কদর বেশি, এগুলো ফেলে দেওয়া যায় না। নতুন বইকে স্বাগত জানিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। তাই লাইব্রেরির জন্য সুপরিসর জায়গা থাকতে হয়।

সব সময় অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত দিয়ে কাজ চলছে। আগে লাইব্রেরির কর্মকর্তা–কর্মচারী ছিলেন ১৪ জন। এখন মাত্র ৬ জন। তাঁদের মধ্যে ৪ জন খেলোয়াড়, যাঁরা পুরোদমে অফিস করেন না। বর্তমানে লাইব্রেরিয়ান, ক্যাটালগার ও অফিস সহকারী পদে কেউ নেই। জানা গেছে, দায়িত্বহীন অজ্ঞ কর্মচারীদের সাজাস্বরূপ লাইব্রেরিতে বদলি করা হয়।

একটি শহর কতটা সভ্য, একটি শহরের মানুষ কতটা শিক্ষিত, তা প্রতিফলিত হয় গ্রন্থাগারের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, সিটি করপোরেশন লাইব্রেরি আমাদের চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ধ্বংস করা ঠিক হবে না।

অস্তিত্ব নিয়ে নতুন শঙ্কা
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, সিটি করপোরেশন এখন লাইব্রেরির জন্য বরাদ্দ দুটি ফ্লোরের একটি বাতিল করে দিতে চাইছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করপোরেশনের খেলার দলের জন্য ওরা আরও একটি ফ্লোর নিয়ে নিতে চাইছে। চার হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে প্রায় ৪০ হাজার বই রাখতে হবে। তখন পাঠক কোথায় বসে বই পড়বেন আর কোথায় বইগুলো সংরক্ষণ করা হবে। যদি তা–ই হয়, তাহলে ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের এখানেই বিলুপ্তি ঘটবে। এটা কোনো সচেতন নাগরিকের জন্য সুখবর নয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন লাইব্রেরি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের একটি গৌরবময় অংশ। এই ঐতিহ্যের এ রকম করুণ পরিণতি কেউ মেনে নেবে না। এমনিতেই চট্টগ্রামের প্রধান গ্রন্থাগারটি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিটি কয়েক বছর ধরে বন্ধ। গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মুসলিম ইনস্টিটিউটকে ঘিরে ওখানে মিলনায়তনসহ গড়ে উঠছে বড় সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স। সেখানেও গ্রন্থাগারটি কী রকম প্রাধান্য পাবে, সে নিয়েও প্রশ্ন অনেক নাগরিকের। তবে আশা করি সেটি যথাযথ মর্যাদায় আরও বড় পরিসরে নবরূপ লাভ করবে। সেটাই বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি অনুকরণীয় হতে পারে। ৩০০ বই দিয়ে যাত্রা শুরু। এখন এর সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখ। পাঠকসংখ্যা ও সময়ের চাহিদার কথা বিবেচনা করে লাইব্রেরির আয়তন ও বইসংখ্যা বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ অস্বাভাবিক। তা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো সিটি করপোরেশনের ক্রীড়া দল আছে বলে মনে হয় না। ক্রীড়া ক্ষেত্রে দলটি কী কী ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে? চট্টগ্রামে খেলার মান উন্নয়নে ও নতুন খেলোয়াড় তৈরিতে দলটির কোনো ভূমিকা আমাদের চোখে পড়ে না। কেন ক্রীড়া দলটি সিটি করপোরেশনের কাছে গ্রন্থাগারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে?

বিলুপ্তি নয়, অক্ষুণ্ন থাকুক ঐতিহ্য
ডিজিটাল দুনিয়ার ক্রম প্রসারণের এই সময়ে কাগজে মুদ্রিত, বাঁধাই করা বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেন। কেউ কেউ আতঙ্কিত হন, বই বোধ হয় জাদুঘরের বস্তুতে পরিণত হবে। সেই সূত্রে গ্রন্থাগারগুলোর ভবিষ্যৎও অনেকে অন্ধকার দেখেন। মানবসভ্যতার অনেক ঐতিহ্য আমরা যেমন হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি হয়তো একদিন গ্রন্থাগারও বিলুপ্ত হয়ে জাদুঘরের বস্তুতে পরিণত হবে। এই শঙ্কা দূর ভবিষ্যতের। বাংলাদেশে বই বা লাইব্রেরির সেই সংকট এখনো আসেনি। কিন্তু সেই সংকট আসার আগেই যদি আমরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে গ্রন্থাগার বিলুপ্তির পথ ত্বরান্বিত করি, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য এটি মোটেও হিতকর হবে না।

একটি শহর কতটা সভ্য, একটি শহরের মানুষ কতটা শিক্ষিত, তা প্রতিফলিত হয় গ্রন্থাগারের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, সিটি করপোরেশন লাইব্রেরি আমাদের চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ধ্বংস করা ঠিক হবে না। আমাদের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। ওখানে একটি বিশাল জায়গা ছিল ছোটদের জন্য বরাদ্দ। নানা রকম বইয়ের পাশাপাশি সেখানে শিশুতোষ সব পত্রিকা পাওয়া যেত। আমরা স্কুল ছুটির দিনগুলোতে সেখানে বইয়ের জগতে বুঁদ হয়ে থাকতাম। আমাদের শৈশব ছিল বইয়ের শৈশব। এখনকার শিশুরা এখন বইমগ্ন নয়, তারা ভার্চ্যুয়াল জগতের ডুবে আছে। বই না পড়ে বড় হওয়া শিশুর কাছ থাকে আমরা খুব মানবিক কিছু কি আশা করতে পারি? একটি প্রজন্মকে বইয়ের দিকে ফেরাতে লাইব্রেরিগুলো শুধু বই সাজিয়ে রেখে বসে থাকলে চলবে না। তাদের বইয়ের দিকে আকর্ষণ করতে নানা প্রোগ্রাম কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। আর তা না করে উল্টো লাইব্রেরিকে সংকুচিত করার পরিকল্পনা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক। [email protected]