চাপে চাপে চ্যাপ্টা জীবন

রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবার। কর্তা ভালো চাকুরে। স্ত্রীও ভালো চাকরি করেন। কর্তাটি এত ব্যস্ত যে ঘরে ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়। কাজেই চাকরি ঠিক রেখে স্ত্রীকে ঘরদোরও সামলাতে হয়। রোজ উঠতে হয় ভোর ছয়টায়। নিজের অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি তো আছেই, হাত চালাতে হয় ছেলেমেয়ের স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে। ছেলেটাকে স্কুলে দিয়ে তিনি যাবেন অফিসে। মেয়েকে নিয়ে যাবেন বাবা। এরই মধ্যে আবার ওদের টিফিন তৈরি করার ব্যাপার রয়েছে। ঘরকন্নার বিষয়ে গৃহকর্মীকে নির্দেশনা দেওয়াও তো আছেনই। ঘরে কী আছে, কী নেই—এর তত্ত্ব-তালাশও নিতে হবে। এই দৈনন্দিন কাজ সবই করতে হবে ঘড়ির কাঁটা ধরে। টিক টিক করে সময় পার হবে, বাড়তে থাকবে কাজের গতি। এর সঙ্গে পাল্লা দেবে বুকের ঢিব ঢিব।

ওদিকে কর্তার ব্যস্ততাও কম নয়। অফিসে গিয়ে চট করে দুটো ফাইল নিয়ে বসতে হবে। মিটিংয়ের জন্য প্রেজেন্টেশন তৈরির কথা। এসব কাজের ফাঁকে বাড়তি দু-পয়সা আয়ের পথ খুঁজতে হয়। এ জন্য কায়দা-কৌশল করে আলাদা সময় বের করতে হয়। এরই মধ্যে এক ফাঁকে ব্যাংকে গিয়ে লোনের বিষয়ে কথা বলতে হবে। প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। তবে সময়মতো লোন না পেলে ওই দারুণ ফ্ল্যাটটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফেরার সময়ে আছে বাজার করার ঝামেলা। পদে পদে টেনশন।

এটা আমাদের রাজধানীর একটি মোটামুটি সচ্ছল কর্মজীবী পরিবারের প্রতিদিনের চিত্র। এর চেয়ে দু-এক ধাপ নিচে নামেন। এখানে প্রতি মাসে আয়ের উৎস থেকে টাকা আসার পর পুরো মাসের একটা বাজেট নিয়ে হ্যাপা পোহাতে হয়। মাসিক খরচের টাকা তুলে রাখার পর দেখা যায়, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল নিয়ে টানাটানি। ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজের বেতন, আনুষঙ্গিক খরচ নিয়ে কাটছাঁট চলতে থাকে। এটা বাড়লে ওটা কমে। শেষতক পরবর্তী মাসের জন্য তুলে রাখা হয় বাকি সমস্যা। কারও বড় ধরনের রোগ হলে ওই পরিবারের সবার চাঁদি দিয়ে ধোঁয়া ছোটার জোগাড়।

আরও নিচে গেলে, যেখানে রিকশাচালক আর হকারদের জীবন, সেখানে সাতসকালেই থাকে জীবিকাকে ঘিরে ছোটার তাড়া। তারা ঘড়ি দেখে না। দেখার প্রয়োজন হয় না। কারণ তারা সময় বোঝে। এই সময় ধরে ছোটার একটা টেনশনে তারাও থাকে।

এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই একটা চাপের মধ্যে থাকে। এই চাপ কখনো কমে না। দিন দিন বাড়ে। এই চাপের মধ্যেই বয়স বাড়ে। মাথায় চকচকে টাক হয়, নইলে ধবধবে সাদা হয়ে যায় চুল। তারপর সেই চাপে চাপেই জীবন শেষ। শরীরের ভেতর এই চাপটা যায় আসলে হার্ট বা হৃদয়ের ওপর দিয়ে।

মাত্র কালই গেল বিশ্ব হার্ট দিবস। ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৪টি দেশে বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হয়। জীবনের মূল চালিকাশক্তি যেহেতু হার্ট বা হৃদ্‌যন্ত্র, কাজেই এর সুস্থতার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। হৃদ্‌রোগকে এখন বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি বলে বিবেচনা করা হয়। জেনেভাভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ হৃদয়ঘটিত রোগে মারা যায়। ২০৩০ সাল নাগাদ তা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কাজেই হৃদ্‌যন্ত্রের সুস্থতার বিষয়ে সচেতন থাকাটা খুব জরুরি।

চিকিৎসক খুব বলেন, চাপ নেবেন না। চাপমুক্ত থাকুন। কাছের মানুষও বলেন, চাপ নিয়ো না। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকো। যা হওয়ার হবে। কিন্তু বললেই কী হয়? সব ছেড়েছুড়ে বিছানায় চিৎপটাং হয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকলেই চাপমুক্ত হওয়া যায় না। চাপ তখন ভর করে চোখের পাতায়। তা ছড়ায় গোটা হৃদয়জুড়ে।

হৃদ্‌যন্ত্রের সুস্থতার বিষয়ে নানা রকম নিয়মপালন ও অনুশীলনের কথা বলা হয়। বলা হয়, যত পারুন হাঁটুন, হালকা ব্যায়াম করুন। মাংস কম খেয়ে বেশি করে মাছ খান। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ। আঁশযুক্ত ফল খান। সবুজ শাকসবজি খান। এসব নিয়ম কমবেশি পালন করা যায়। কিন্তু চাপমুক্ত থাকার কথা বললেই হোঁচট। ধরুন, জরুরি কাজে কোথাও যাচ্ছেন, তা যেকোনো বাহনেই হোক। কোনো ট্রাফিক মোড় বা সরু গলিতে আটকা পড়ে গেলেন। তখন কী হবে? টিক টিক করে সময় পার হবে, আর আপনি ভেতরে-বাইরে ঘামবেন। পরীক্ষা বা জরুরি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টের বিষয় থাকলে তো কথাই নেই। এ সময় সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত মুখের মিষ্টি হাসিও ভয়ানক তেতো লাগবে। কাউকে সামান্য কথা বলতে গেলেও দেখবেন গলা থেকে খেঁকানি বেরোচ্ছে। কোনো দাওয়াইয়ে প্রশমিত হবে এই টেনশন?

আবার ধরুন, কোনো তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে গেছে, কোনো কারণে সময়মতো বাসায় ফিরল না। ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় বা অন্য কোনো কারণে তার মুঠোফোন বন্ধ। বাবা বা মা বারবার ফোন করেও নাগাল পাচ্ছেন না। এই টেনশন প্রশমনের কোনো উপায় আছে?

ধরা যাক, শাহবাগের মোড়ে কোনো মিছিল বা অবরোধ থেকে বেধে গেছে গোল। আপনার ভাই বা বোন কোনো কাজে ওদিকেই গেছে। বারবার ফোন করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন লাগবে তখন?

নামকরা কোনো স্কুলে পড়ে আপনার সন্তান। ফল খারাপ হলেই বের করে দেবে। এটাই সেখানকার নিয়ম। গত টেস্টে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। সামনে বের করে দেওয়ার সমূহ ঝুঁকি। আরাম করে ঘুমাতে পারবেন?

চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। বেড়েছে সাবানের মতো নিত্যপণ্যের দাম। ওষুধের মতো জরুরি পণ্যের দাম ধাঁই করেছে আকাশ পানে। এর মধ্যে চাপ কমানোর সুযোগ কোথায়?

প্রতিবেশী বা খুব কাছের কেউ ধা ধা করে এগিয়ে যাচ্ছে, আমার কিছু হচ্ছে না—এ ধরনের মানসিকতাও একধরনের চাপে রাখে। যোগ্যতা ও সামর্থ্য বিবেচনা না করেই তখন সাফল্যের পেছনে ছোটা হয়। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। মাঝখান থেকে আহার-নিদ হারাম।

এসব চাপ আসলে কখনো কমবে না। সব সময় থাকবে। এর মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে সরল চিন্তা চাপ সয়ে নেওয়ার সহজ পথ বাতলে দিতে পারে। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে যানজটের বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখা উচিত। এটা কেবল রাজধানীই নয়, দেশের অনেক শহরে রোজকার সমস্যা। সে ক্ষেত্রে সময় হাতে রেখে আগে বের হলে যানজট মাথাব্যথার কারণ না-ও হতে পারে। ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে পড়তেই হবে, থাকতেই হবে, এমন আশা তো থাকবেই; কিন্তু তা যেন বদ্ধমূল ধারণার মতো শিকড় না গাড়ে। এ দেশে কজন শিক্ষার্থী ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পায়? গ্রামেগঞ্জে রিকশা চালিয়ে, না খেয়ে-না দেয়ে কি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে ফলাফলে চমক দেখাচ্ছে না? অদম্য মেধাবীর খাতায় নাম লিখিয়ে এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে যাচ্ছে না? তাদের সাফল্যের কথা মনে করে ভালো স্কুল নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভোগা থেকে রেহাই পেতে পারি।

কোথায় কার কী হলো, আমার কিছু হলো না—এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার দরকারটা কী? আমার যা আছে, তা-ই নিয়ে তুষ্ট থাকি না। এতে চাপ হয়তো পুরোপুরি কমবে না, তবে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে জীবন।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাংবাদিক
[email protected]