কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে যতসংখ্যক মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়া দরকার বলে অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা, সেই সংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে কত দিন সময় লাগবে? অর্থাৎ সহজভাবে বললে, পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে কত সময় লাগবে? বেশির ভাগ মানুষের উত্তর হচ্ছে ২০২৩ অথবা ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। এই সময়সীমা আসলে ধনী রাষ্ট্রগুলোর বাইরে অন্যান্য দেশে টিকা প্রদানের অগ্রগতি সম্পর্কে গভীর হতাশাকেই ইঙ্গিত করে। এসব কারণে সম্প্রতি জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে দরিদ্র দেশগুলোকে এ বছর এবং ২০২২ সালে এক বিলিয়ন টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এ জন্য জি-৭ বিরাট আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তাদের এই আত্মতুষ্টিতে ভোগা খুবই ভুল এবং হতাশাজনক। সবার আগে নিজেকে বোঝাতে হবে যে সমস্যাটি সমাধানযোগ্য, আর এটিই হচ্ছে যেকোনো সমস্যা সমাধানের কার্যকর উপায়। সে লক্ষ্যে গ্লোবাল কমিশন ফর পোস্ট প্যানডেমিক পলিসি তৈরি করা হয়েছে। সেই পলিসির অধীনে বিশ্বের উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন ও নির্দলীয় ৩৪ জন চিন্তাবিদ কাজ করছেন। তাঁরা এখন টিকা কার্যক্রমে সফলতার ক্ষণগণনা করছেন। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করছি, সমস্যাটিকে যতটা কঠিন মনে করা হয়েছিল, তা আসলে ততটা কঠিন নয়। এটি খুব সহজেই সমাধানযোগ্য একটি সমস্যা এবং জি-৭-ভুক্ত দেশের সরকারগুলো যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, তার চেয়েও দ্রুততম সময়ে সমাধান করা সম্ভব।
হিসাবটি সহজ। তবে প্রথমেই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনকে আপনি অনুপ্রেরণা কিংবা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করবেন কি না। বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত বলছে, বিশ্বে এখন প্রতিদিন ৩৩ থেকে ৩৬ মিলিয়ন ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে খোদ চীনেই দেওয়া হচ্ছে ১৭ থেকে ২০ মিলিয়ন। সুতরাং চীনকে গণনায় ধরলে বৈশ্বিক টিকা প্রদান কর্মসূচি শেষ হতে সময় লাগবে ২০০ দিন। আর চীনকে হিসাবের বাইরে রাখলে সময় লাগবে ৩৭০ দিন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য।
চলুন, সংখ্যাটির দিকে নজর দেওয়া যাক। বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭৯০ কোটি। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৫৮৫ কোটি (৭৪ শতাংশ)। যদি ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে ৪৭০ কোটি মানুষের টিকা লাগবে। দুই ডোজ করে হিসাব করলে ৯৪০ কোটি ডোজ। ১১ জুন প্রকাশিত বৈশ্বিক উপাত্ত থেকে জানা যায়, ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ২৩০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে ৭০০ কোটি ডোজ।
হ্যাঁ, ৭০০ কোটি ডোজ একটি বিশাল বড় সংখ্যা। কিন্তু লক্ষ করে দেখুন, ঘটনা কী ঘটছে। চীন প্রতিদিন ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ২ কোটি ডোজ দিচ্ছে, ভারত দিচ্ছে ৩০ লাখ, এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোতেও ৯ লাখ ডোজ রোজ দেওয়া হচ্ছে, যা টিকা দেওয়া শুরুর মাস থেকে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে এ পর্যায়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বেশির ভাগ দেশেই টিকাদানের সংখ্যা বাড়ছে।
চীনের দুই টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম মোট উৎপাদনের অর্ধেক টিকা একাই উৎপাদন করেছে। তারা তাদের মাসিক উৎপাদন বাড়াচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে ফাইজার-বায়োএনটেক ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের টিকার উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসন তাদের টিকার উৎপাদন বাড়িয়েছে। শুধু হতাশ করেছে ভারত। সেখানে টিকার উৎপাদন এপ্রিল মাসে ৭ কোটি ৬০ লাখ থেকে কমে মে মাসে ৬ কোটি ২৬ লাখে নেমে এসেছে।
আমাদের ধারণা যদি ভুল না হয়, চীন সম্ভবত এই টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চীন তার দেশের সব মানুষকে টিকা দিয়ে ফেলবে। জি-৭-ভুক্ত দেশগুলো চাইছে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তাদের প্রতিশ্রুত টিকা দিয়ে ফেলতে। কিন্তু দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর টিকা দরকার আরও আগে। এর অর্থ হচ্ছে ২০২১ সালের শেষ ৪ মাসে ৫০ কোটি ডোজ উৎপাদন ও বিপণনের এক বিশাল বাজার ও কূটনৈতিক সুযোগ পাচ্ছে চীন।
যদি তেমনটা ঘটে, তবে বৈশ্বিক টিকাদানের যে সংক্ষিপ্ত সময়সীমা ধরা হয়েছে, তা আরও সংক্ষিপ্ত করা যেতে পারে। টিকা মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে আফ্রিকার প্রান্তিক অঞ্চল এবং লাতিন আমেরিকার ভঙ্গুর অর্থনৈতিক দেশগুলো। তবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, যদি চীনসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। সফলতা নির্ভর করছে দেশগুলোর উদারতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ওপর।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● বিল ইমোট দ্য ইকোনমিস্ট-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক এবং দ্য গ্লোবাল কমিশন ফর পোস্ট প্যানডেমিক পলিসির সহপরিচালক