চিলিতে যে কৌশলে ক্ষমতায় প্রাক্তন ছাত্রনেতা বোরিক

গ্যাব্রিয়েল বোরিক
এএফপি

অনেক বছর ধরে লাতিন আমেরিকায় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল চিলি। সে কারণে চিলিবাসী যখন তাদের নির্বাচনে ৩৫ বছর বয়সী প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং বামপন্থী গ্যাব্রিয়েল বোরিককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করলেন, তখন বাকি লাতিন আমেরিকা সাগ্রহে জানতে চায়, এ ঘটনা চিলি ও তাদের জন্য কী অর্থ বহন করছে?

সবার আগে নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দেওয়া যাক। বোরিক ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ১০ শতাংশের বেশি ভোটে জেতা চিলির ইতিহাস বিবেচনায় এটি বিশাল জয়। ১৯৮৯ সালে চিলিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে যত নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে ৪-৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা জিতেছেন। এবারের নির্বাচনে বোরিকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জোসে আন্তোনিও কাস্ত। তিনি শুধু প্রথম দফা ভোটেই জেতেননি, দ্বিতীয় দফায় ৪৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থনও আদায় করে নিয়েছেন।

সাম্প্রতিক এ নির্বাচন চিলির ১৯৮৮ সালের গণভোটেরই প্রতিচ্ছবি। দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশের মেয়াদ আরও আট বছরের জন্য বাড়ানো হবে কি না, সেই সিদ্ধান্তে গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। সেই নির্বাচনে পিনোশের সমর্থকেরা হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অতি ডানপন্থী সমর্থকেরা থেকেই গেছেন।

চিলির দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সব সময়ই মেরুকরণ হয়। কিন্তু এ নির্বাচনে চিলির জনগণের মধ্যে স্পষ্ট যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, সেটা স্মরণকালের মধ্যে প্রকট। সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে মনে হয়, এ নির্বাচন চিলি ও লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের ওপর যে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম দফা নির্বাচনে বোরিক বিভিন্ন ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, বৃহত্তর ফ্রন্ট, পরিবেশবাদী, নারীবাদী ও এলজিবিটিকিউ অধিকারকর্মীদের নিয়ে জোট গড়েছিলেন। শেষ দফায় তিনি তাঁর জোটকে আরও বড় করেন। সোশ্যালিস্ট, দ্য সেন্টার লেফট পার্টি ফর ডেমোক্রেসি, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ আরও কিছু মধ্যপন্থী দলকে তাঁর জোটে যুক্ত করেন। বোরিকের এ জগাখিচুড়ি জোট নিয়ে চিলির রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্যাট্রিসিও নাভিয়া প্রশ্ন করেছেন, বোরিকের সরকারের অবস্থান কী হবে?

এ বিষয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করার আগে আমাদের ২০১৯ সালে ফিরে যেতে হবে। সে সময়ে চিলিবাসী একগুচ্ছ দাবি নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছিলেন। নিম্ন মজুরি, অপর্যাপ্ত আবাসন, অবসর ভাতা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া, ব্যয়বহুল ও জটিল স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ বিপর্যয় এবং নারী ও আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন—এসব বিষয়ে তঁারা আন্দোলন করেছিলেন। জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসমতার ক্ষোভ ফুটতে ফুটতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল।

গত কয়েক বছরে চিলি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘অবিশ্বাস্য’ অগ্রগতি অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও দেশটিতে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিলির অনেকে মনে করেন সম্পদের ন্যায়সংগত বণ্টন না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অসমতা পরিমাপের জন্য জিনি সহগ সূচকটি ব্যবহার করা হয়। এ সূচক অনুসারে গত ২০ বছরে চিলিতে বৈষম্য বেড়েছে।

বোরিক তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু, পেনশনব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, ছাত্রদের ঋণ মওকুফ ও সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সামাজিক খাতে জিডিপির ৮ শতাংশ ব্যয় করার ঘোষণা দেন। বড় কোম্পানি ও ধনী ব্যক্তিদের ওপর কর বাড়িয়ে বাড়তি এ রাজস্বের সংস্থান তিনি করতে চান। বোরিকের এ কর্মসূচি বৈপ্লবিক নয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আইনসভার বামপন্থী সদস্যদের সঙ্গে এ কর্মসূচি মিল ছিল।

কিন্তু শেষ দফা নির্বাচনে বোরিক তাঁর অবস্থান নমনীয় করেন। চিলির ‘অবিশ্বাস্য অর্থনীতি’র জন্য যাঁদের দায়ী করা হয়, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে তিনি মৈত্রী স্থাপন করেন। তাঁদের মধ্যে সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো লাগোস ও মিশেল ব্যাচেলেটও রয়েছেন। এ বিবেচনায় বোরিকের শেষ দফার জোট অনেক বেশি সংস্কারবাদী এবং আদি জোটের প্রতিশ্রুতিগুলো থাকা সত্ত্বেও অনেক কম র‍্যাডিক্যাল।

চূড়ান্ত বিচারে বোরিক শুধু মধ্যপন্থী, প্রথাগত ও পুরোনো আইনসভার সদস্যদের সমর্থনে জেতেননি। তিনি তরুণ ও র‌্যাডিক্যাল সমর্থকদের ভোটেও জিতেছেন। এর মানে সহস্রাব্দের এ প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক সত্তার যুদ্ধটা ফেনিয়ে উঠছে। বোরিকের অবস্থা কী, সেটা বৃহত্তর একটি পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বুঝতে সহজ হবে। লাতিন আমেরিকায় এখন স্পষ্টত দুই ধারার রাজনীতি রয়েছে। প্রথম ধারায় মধ্যপন্থী, গণতন্ত্রী, বিশ্বায়নবাদী ও আধুনিক বামেরা রয়েছেন। দ্বিতীয় ধারায় উগ্র দেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী, রাষ্ট্রবাদী ও কর্তৃত্ববাদী বামেরা রয়েছেন।

কারাকাস, হাভানা, বুয়েনস এইরেস থেকে গোঁড়া বামপন্থীরা বোরিককে তাঁদের একজন মনে করে চিলির নির্বাচনের ফলাফল উদ্‌যাপন করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের হতাশ হতে হবে। চিলির সাম্প্রতিক ইতিহাস, শেষ ধাপ নির্বাচনের ফলাফল এবং সরকার গঠন করতে যাওয়া জোটটির ধরন বিবেচনা করলে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বোরিক লাতিন আমেরিকার জনতুষ্টিবাদী ধারার বামপন্থী সরকার গঠন করবেন না। এর বদলে ইউরোপের সামাজিক গণতন্ত্রীদের মতো একটা সরকার তিনি পরিচালনা করবেন। চিলি ও লাতিন আমেরিকার মঙ্গলের জন্য সেটাই হওয়া উচিত।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • হোর্হে হি কাস্তানেদা মেক্সিকোর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী