অনেকগুলো প্রকল্পে ভারতের ঠিকাদার-পরামর্শকদের খামখেয়ালিপনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ, রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এর উদাহরণ। এত সব শর্তের বেড়াজাল মেনে নিয়ে ভারত থেকে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ নেওয়া বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিবেচিত হওয়ায় চট্টগ্রাম বে টার্মিনালে ভারতীয় অর্থায়নের প্রস্তাব বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি।
কথিত চীনা ঋণের ফাঁদে ক্রমেই জড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ—এ ধরনের প্রচার-প্রোপাগান্ডা প্রধানত ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সাম্প্রতিক কালে ঘন ঘন পরিবেশিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বহুল আলোচিত প্রায় এক বিলিয়ন ডলার প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এহেন ভারতীয় প্রচার-প্রোপাগান্ডা তুঙ্গে উঠেছে (এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি বাংলাদেশের অনুরোধে সম্পন্ন করেছে চীন)। বিশেষত, বাংলাদেশ কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর চীন বাংলাদেশকে ঋণের পর ঋণ দিয়ে ভারত থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে বলে প্রচার-প্রচারণা অনেকখানি বেড়েছে।
অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে ভারতের ‘লাইন অব ক্রেডিট’–এর শর্তগুলো বাংলাদেশের জন্য বহুদিন আগেই অবাস্তব হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রকল্পের ঠিকাদার, পরামর্শক ও যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে ইট-বালু-সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রী পর্যন্ত ভারত থেকে আমদানি করার বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিটি ভারতীয় ঋণে অর্থায়িত প্রকল্পে, ফলে এই ঋণগুলোকে ‘টাইড এইড’-এর ক্ল্যাসিক নজির আখ্যায়িত করাই সমীচীন। অনেকগুলো প্রকল্পে ভারতের ঠিকাদার-পরামর্শকদের খামখেয়ালিপনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ, রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এর উদাহরণ। এত সব শর্তের বেড়াজাল মেনে নিয়ে ভারত থেকে ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ নেওয়া বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিবেচিত হওয়ায় চট্টগ্রাম বে টার্মিনালে ভারতীয় অর্থায়নের প্রস্তাব বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি।
পশ্চিমা এবং ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে চীনের ‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়ে প্রোপাগান্ডা ২০১৬ সালে গণচীন কর্তৃক ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) বা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবোর) ঘোষণার পর থেকে নাটকীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষত, নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার) ইকোনমিক করিডর পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং চীনের প্রতি বৈরিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকেই হয়তো এত দিনে ভুলে গেছেন যে ভারতের কংগ্রেস সরকার অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ২০০৬ সালে ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার আরেক নাম ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’। ওই চুক্তির অধীনেই চীনের কুনমিং থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স হয়ে বাংলাদেশের সিলেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে ঢাকা হয়ে ভারতের কলকাতা নগরী পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সেই কানেকটিভিটির পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়। এমন পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক-এডিবি-জাইকা-আইডিবির ঋণের পরিবর্তে বাংলাদেশ যখন নিজস্ব অর্থায়নে ওই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তখন চীনা কোম্পানিগুলোকে পদ্মা সেতুর ঠিকাদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতএব পদ্মা সেতুকে ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ আখ্যায়িত করা একেবারেই ভিত্তিহীন মিথ্যাচার।
পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী বর্তমান স্যাটেলাইটের সক্ষমতাই আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। এই অবস্থায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ অযৌক্তিক। এ ধরনের ব্যয়বহুল অথচ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মোহে ডুবতে থাকলে বাংলাদেশও একসময় ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকে যাবে।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়িত প্রকল্প, এখানে কোনো চীনা ঋণ নেই। আবার ওই ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ চুক্তির অধীনেই বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ স্থাপন করে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং নগরীর সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। ২০১২ সালে যখন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তাঁকে সোনাদিয়া প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অনুরোধের ‘ফলোআপ’ হিসেবে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় যখন দুই দেশের মধ্যে ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ স্বাক্ষরের ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়েছিল, তখন ভারতে সদ্য ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শেষ মুহূর্তের সরাসরি চাপে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প থেকে সরে আসতে বাংলাদেশকে বাধ্য করা হয়েছিল।
ঋণের ফাঁদের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণের অর্থে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসা উচিত। প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই নির্মীয়মাণ প্ল্যান্ট প্রকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে কখনোই ‘ফিজিবল’ প্রমাণ করা যাবে না। কারণ, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো বিকল্প প্রযুক্তি বিশ্বে পাওয়া যাবে, যেখানে এর অর্ধেকের কম ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রকল্পে ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ অনেক বেশি নিরাপদে উৎপাদন করা যাবে। ঋণ পাওয়া গেলেই পারমাণবিক প্রকল্পের মতো একটা মহা বিপজ্জনক প্ল্যান্ট বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের সীমানার একেবারে মাঝখানে পাবনার রূপপুরে স্থাপন কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? (শোনা যাচ্ছে, চীনের অর্থায়নে পটুয়াখালীতে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াধীন!)
দ্বিতীয় যে কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের উল্লেখ করব, সেটা হলো চীনা ঋণে অর্থায়িত ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইন। পদ্মা সেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। অথচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। যমুনা রেলসেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে বর্তমান বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর রেলপথের সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে। আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী বর্তমান স্যাটেলাইটের সক্ষমতাই আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। এই অবস্থায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ অযৌক্তিক। এ ধরনের ব্যয়বহুল অথচ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মোহে ডুবতে থাকলে বাংলাদেশও একসময় ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকে যাবে।
মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক