চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন ভিন্ন চোখে দেখে বাংলাদেশ
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসাটা আমার জন্য সব সময়ই আনন্দের। দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্মেলনে যোগ দিতে যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখনো এর ব্যতিক্রম ছিল না।
অবাক ব্যাপার হলো আমি যানজটমুক্ত সড়ক দিয়ে হোটেলে ফিরছিলাম। এ সময় একটি মৌন মিছিল আমার সামনে এসে পড়ে।
প্রায় ৫০ জনের একটি চীনা দল শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরে বুঝতে পারি, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে তাঁরা এসেছেন। গত তিন দশকের মধ্যে এটি ছিল চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের প্রথম ঢাকা সফর।
গোয়ায় ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে ঢাকায় চীনা প্রেসিডেন্ট ২৪ ঘণ্টার কম সময় অবস্থান করেন। কিন্তু শহর দেখে মনে হয়, সফররত চীনা প্রেসিডেন্টকে মুগ্ধ করার চেষ্টার কমতি নেই।
আমি ও সম্মেলনের অন্য অংশগ্রহণকারীরা যে হোটেলে ছিলাম, সেখানে চীনা প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। হোটেলের চমৎকার একটি লবিকে প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তর করা হয়েছিল।
ঢাকার প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সি চিন পিংয়ের ছবি, যা তাঁদের নিজেদের আকারের চেয়ে বড় ছিল। এই ছবিগুলোর সঙ্গে আলোকসজ্জা ঢাকার সাধারণত অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তাকে উজ্জ্বল করে তুলেছিল। বিশেষ করে সাধারণের ব্যবহারের স্থান বন্ধের চেষ্টার বিষয়টি ছিল হোটেলের অন্য সব অতিথির জন্য যন্ত্রণাদায়ক। তাহলে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের অন্যান্য অতিথির এই সময়টায় অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে পারত।
চীনা প্রেসিডেন্টে এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
চীনের বাংলাদেশের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মওকুপের সম্ভাবনা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দ্রুত দৃঢ়তার দিকে নিয়ে যায়, যা নজিরবিহীনও ছিল না, অস্বাভাবিকও নয়।
বাস্তববাদ কীভাবে আদর্শকে ছাপিয়ে যায়, তা বোঝার জন্য চীন-বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনুসরণ করা যেতে পারে। চীন একসময় বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অনাগ্রহী ছিল। এখন তারা কৌশলগত অংশীদার। তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যার অধিকাংশই চীনের অনুকূলে।
এই বিপুল বাণিজ্যঘাটতি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনো বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি। এক বছর আগেও দেশটির সঙ্গে ছয় বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যঘাটতি ছিল।
চীন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করছে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর মধ্যে ১৩টিই অবকাঠামো, নির্মাণ, জ্বালানি ও পরিবহন-সংক্রান্ত।
সি চিন পিংয়ের সফরের সময় বাঁশখালীতে চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। অন্যদিকে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রকল্প রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশটিতে নেতিবাচক ধারণা বাড়ছে। অথচ বাঁশখালীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকালে সেখানে চারজনের প্রাণ গেলেও তা নিয়ে তেমন প্রতিবাদ দেখা যায়নি।
ভারত ও চীনকে বাংলাদেশ কেন ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, তা বোঝা কঠিন নয়।
বাংলাদেশের নেতারা ও রাজনৈতিক দলগুলো বেইজিংয়ের সঙ্গে অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতায় অযথা উদ্বিগ্ন নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিতর্কে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে চীনের অস্বীকৃতি এবং কোনো দল বা আদর্শের প্রতি তাদের অনুরাগ না থাকার বিষয়টি বেইজিংয়ের জন্য ভালো কাজ দিয়েছে। ঢাকার ওপর বেইজিংয়ের প্রভাব স্পষ্ট। বর্তমানে তাদের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের ক্ষেত্র প্রসারিত।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ককে নাটকীয় হিসেবে দেখা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বারবারই ভারতের বড় ভাইসুলভ আচরণের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ইতিহাস ও ভৌগোলিক সমস্যায় বিজড়িত। এ সম্পর্ক বিরোধপূর্ণ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার।
চীনকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখে বাংলাদেশ। আর ভারতকে দেখে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে, যারা প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু তার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখা যায় না।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক যে দেশটির সব মহলে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তা চীনা প্রেসিডেন্টের অল্প সময়ের, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ সফরে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি তেমনটা ব্যাপকভিত্তিক সমর্থন নেই।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে ফারাকের মূলে কেবল ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে—৪০ বছর পর এ কথা বলার অবকাশ নেই। বস্তুত, এখানে গভীরতর রাজনৈতিক বিভক্তি আছে, যা সামনে আনা দরকার।
শ্রীরাধা দত্ত: পরিচালক, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ, কলকাতা। নিবন্ধটি দ্য ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত