ছুটি পেলে গরিব-গরবা মানুষ কেন ‘দেশে’ যায়

সুযোগ পেলেই গরিব-গরবা মানুষগুলো কেন শহর থেকে গ্রামে যায়? দুর্ধর্ষ করোনা, কঠোর বিধিনিষেধ কিছুই তাদের ঠেকাতে পারে না। সরকারের বিধিনিষেধ, চাকরি যাওয়ার ভয়, পথে পথে ঝুঁকি-দুর্ঘটনা, কিছুই তারা পরোয়া করে না। গ্রামে যাবেই। এই প্রশ্ন অনেকেই করেন। বিশেষ করে ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষেরা। গরিব মানুষগুলোর জন্য তাদের দরদ উথলে উঠেছে, ভাবার কারণ নেই। তারা প্রশ্ন করেন নিজেদের স্বার্থে। বাসার গৃহকর্মী কিংবা গাড়ির চালক ‘দেশে’ গেলে তাদের জীবন প্রায় অচল।

আমরা জনি, গ্রামে এই মানুষগুলোর পরিবার-পরিজন আছে। আত্মীয়স্বজন আছে। বন্ধুরা আছে। ভিটেমাটি আছে। তবে এসবই তাদের গ্রামে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। আরও কারণ আছে। জীবিকার জন্য তারা যে শহরে এসে ঠাঁই নিয়েছে, সেই শহর কখনো তাদের আপন ভাবে না। শহর হলো বিত্তবানদের জন্য। শহর হলো ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-মন্ত্রী-আমলাদের জন্য। তাঁদের আরাম-আয়েশের জন্য, তাঁদের জীবনকে সহজ করার জন্য গ্রাম থেকে কিছু মানুষকে নিয়ে আসা হয়।

শহরে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের দেখি একটি বিষয়ে খুব আক্ষেপ করেন। আগে তাঁরা চাইলেই গ্রাম থেকে গৃহকর্মী নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসার ঘটার পর ঘরে ঘরে গৃহকর্মী পাওয়া যায় না। এই তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা যতই শোষণ করুন না কেন, তাঁদের কল্যাণে গ্রামের হতদরিদ্র ও প্রায় লেখাপড়া না জানা মেয়েরা মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা ব্যাংক হিসাব বা বিকাশ-নগদের মাধ্যমে মাসের মজুরি তুলে নেন। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসটি নিজে কিনে নেন। কারখানার কর্মী হিসেবে একটি আইডি কার্ড ও তার গলায় ঝোলানোর সুযোগ পান। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে এসব কিছুই করার অধিকার তাদের ছিল না। তৈরি পোশাকশিল্প সমাজে নীরবে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে।

কিন্তু আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে যে শহর এমনই নিষ্ঠুর যে প্রয়োজনের বেশি এক দিনও এই গরিব-গরবা মানুষগুলোকে রাখবে না। কাজ হারালে কিংবা কাজ করতে অপারগ হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। আবার গ্রামেই তাদের চলে যেতে হয়। রানা প্লাজা ধসে পড়লে ১ হাজার ১ শর বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন। আহত হন আরও কয়েক হাজার। তাজরীনেও আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিক মারা যান। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও কারখানা মালিকেরা তাদের কতটা খোঁজখবর রেখেছেন? এখনো ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার ক্ষতিপূরণের জন্য আহাজারি করেন। যারা পঙ্গু হয়ে গেছেন, বাকি জীবন দীর্ঘশ্বাসই সঙ্গী। তাঁদের গ্রামেই ফিরে যেতে হয়েছে।

ঈদের সময় কিংবা অন্যান্য পার্বণে দুই শ্রেণির মানুষ গ্রামে যায়। একশ্রেণির মানুষ হলো ধনী ও ক্ষমতাবান। শহরে থাকলেও গ্রামে তাঁদের জমিজমা আছে। শানশওকতওয়ালা বাড়ি আছে। এই বাড়ি ও জমিকে কেন্দ্র করে তারা কিছু অনুগত মানুষ তৈরি করেন। এই শ্রেণির মানুষেরা স্থায়ীভাবে শহরে থেকেও গ্রাম সমাজে কর্তৃত্ব করেন। প্রয়োজনে মানুষকে দানখয়রাত করেন। তবে এই দানখয়রাতের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। নির্বাচনের সময় এলে তাঁরা অনুগত লোককেই দরের মনোনয়ন পাইয়ে দেন। জিতিয়ে আনেন। এভাবে শহুরে ভদ্রলোকেরা গামের জমিদারি টিকিয়ে রাখেন। এই শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রামে যাওয়া হলো ক্ষমতা প্রদর্শন। অর্থের দাপট দেখানো। তাঁরা গ্রামে গিয়ে ক্ষমতা ও বিত্তের গরিমা দেখানোর সুযোগ পান।

দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ বছরের পর বছর শহরে থাকলেও ভাসমান। তাঁরা জীবিকার জন্য শহরে আসেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শহরের ভদ্রলোকদের সেবা করেন। তাদের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করেন। তাঁরা কেউ রিকশা-ভ্যান-অটোরিকশা চালান, কেউ ফুটপাতে হকারি করেন। মাথায় বোঝা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পণ্য বিক্রি করেন। তাঁদের কেউ ভদ্রলোকদের জন্য বালাখানা তৈরি করেন যেখানে তার প্রবেশ করার অধিকার নেই। এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই শহরের বস্তিতে মানবেতর পরিবেশ থাকেন এক কক্ষে পাঁচ-সাতজন গাদাগাদি করে।

মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে দেখেছি, এক কক্ষে মা-বাবা, ছেলে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনি বাস করছেন। এই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর জীবনও ক্যাম্পেরই জীবন। কেবল ঘর নয়, ঢাকার আকাশও তাঁদের কাছে পর মনে হয়। বেঁচে থাকার জন্য তাঁরা ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা অন্য কোনো শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু শহর তাঁকে কখনোই আপন করে নেয়নি, নেবে না।

এ কারণেই গরিব-গরবা মানুষগুলো একটু সুযোগ পেলে, ছুটি পেলে গ্রামে যান। গ্রামে তাঁদের আর কিছু না থাক, অন্তত একটি ভিটা আছে। আত্মীয়স্বজন আছেন। তাঁরা শহরকে কখনো আপন ভাবতে পারেন না। ভাবতে দেওয়া হয় না। আবার এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর সেবা ছাড়া শহর অচল। তাঁরা শহরের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু শহর তাঁদের উটকো ঝামেলার চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না।

গত ঈদের সময় গণপরিবহন বন্ধ ছিল। এই মানুষগুলো রিকশা, ভ্যান, ট্রাক, নছিমন, করিমন যা পেয়েছেন, তাতেই উঠে বসেছেন। কিছু না পেলে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। তাঁরা কীভাবে বাড়ি যাবেন, কীভাবে ফিরবেন, এসব নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাষ্ট্র চায় তাঁদের সেবা। ধনী মানুষেরা চান তাঁদের সেবা। সেবা পাওয়ার জন্য এই মানুষগুলোকে দরকার। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তাঁদের জীবন নেই। স্বপ্ন নেই। সাধ-আহ্লাদ নেই।

এই শহর গ্রামের গরিব-গরবা সব মানুষকে নিয়ে এলেও সবাইকে ঠাঁই দেয় না। অনেকে ছিটকে পড়েন। শহরে থাকতে পারে না। এই যে কয়েক দিন আগে মগবাজারে যে গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটল, তাতে ৯ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিল। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বাসচালক। তিনি তখন আউটার সার্কুলার সড়কে যানজটে আটকা পড়া বাসের স্টিয়ারিং ধরে ছিলেন। সেই অবস্থায় বিস্ফোরণ তাঁর জীবন কেড়ে নেয়। স্ত্রী ও সন্তান রেখে গেছেন। তাঁরা হয়তো আর ঢাকায় থাকতে পারবেন না।

আমরা অনেক প্রবাসী শ্রমিককে জানি দুই তিন দশক ধরে বিদেশে আছেন। অনেকের জীবনের বড় সমস্যাটা সেখানে কেটেছে। কিন্তু তারা সেই দেশকে কোনোভাবে নিজের মনে করেন না। বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেসব বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন, তারা বছরে এক আধবার দেশে আসার সুযোগ পান। বেশির ভাগ সময়ই তাদের কাটে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। তারপরও তারা ওই দেশে অপর হয়ে আছেন।

দেশের ভেতরেও যারা গ্রাম থেকে শহরে আসেন জীবিকার তাগিদে, তারাও আলো ঝলমলে শহরকে নিজের ভাবতে পারেন না। কীভাবে পারবেন, এই ইট-সিমেন্টের শহরে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টের নোটিশ টানানো থাকে, ‘ড্রাইভার ও গৃহকর্মীরা লিফট ব্যবহার করতে পারবে না।’ সম্মানার্থক ‘ন’ শব্দটি কখনোই তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। ভদ্রলোকদের কাছে তারাও অপর থেকে যায়।
শহর থেকে তাঁদের গ্রামে যাওয়া কেবল বেড়াতে যাওয়া নয়। গ্লানি থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়াও বটে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]