ছেচল্লিশ ফোঁটা ঘামের দাবি

.
.

নিরাপদে থাকার চেষ্টা রয়েছে, আবার চুপচাপও কেউ নেই। প্রকাশ্যে সবাই গন্ডার, অপ্রকাশ্যে সংবেদনশীল মানুষ। মানুষ চলছে, বলছে। অলক্ষ্যে সব যেন গতিহীন। সব আছে, থেকেও নেইয়ের অনুভব মনে মনে। খবরে লেখা হয়, অধিকাংশ রেস্তোরাঁ বেশির ভাগ সময় শূন্য থাকে। ঢাকার বাসিন্দাদের জীবনে বিনোদন বলতে তেমন কিছু নেই। ছিল ঘর ছেড়ে কোথাও খেতে যাওয়া। খাওয়ার চেয়ে মধুর সময় কাটানোর আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য ছিল। মন ও মানুষ উভয়েই আর সেমুখো হতে চায় না। সাধারণদের বলনের পাশাপাশি চলনও আটকে গেল।

বিশেষ সুবিধাভোগীদের পক্ষে এই যাতনা বোঝা সম্ভব নয়। তারা যখন যেমন খুশি বলতে পারে, তাদের চলন প্রক্রিয়াও বিশেষ। সংকটকালে সাধারণ ও বিশেষদের এই পার্থক্য সাহসের বদলে শঙ্কা বাড়ায়। পারস্পরিক আস্থার অভাবে অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের সমাজে যেমনই সংকটের আবির্ভাব ঘটুক সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা বাদ দিয়ে মানবিকতার তোয়াক্কা না করে সুস্থ সমাধানের নাগাল পাওয়া কঠিন। অস্থিরতা সামলাতে সুস্থিরতাই প্রথম প্রয়োজন। ঝোড়ো সতর্কতায় বহু মানুষের নাস্তানাবুদ দশা। বিবিধ পরিচয়ের মানুষের যাতনা বিবিধ রকম।

দেশের সংকটকালে মানুষ হাঁসফাঁস দশা ঘোচানোর জন্য খবর খোঁজে। এখানে কান পাতে, ওখানে মন দেয়। দায়িত্ববান, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মত-অভিমতের আশায় চোখ-কান মেলে রাখে। এমন স্পর্শকাতর সময়ে টেলিভিশন, খবরের কাগজে একেক ওজনদার মানুষের কথা একেক রকম হলে আশা টিকিয়ে রাখার উপায় থাকে না।

যাদের বলা বন্ধ, তাদের দেখার চোখ খোলা, কানও খোলা থাকে। মনের জানালা বন্ধ নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদের জ্ঞান, বিচার-বুদ্ধি, অনুভব—সবই দিয়েছেন, শুধু পরিচয় সেঁটে দিয়েছেন সাধারণের। যাদের বলতে মানা নেই, হিসাব কষে কথা বলার দরকার পড়ে না বলে তারা নিজেদের ভাবে বিশেষ। সে বিশেষ অনুভবের বিচিত্র ঠ্যালা সামলাতে হয় বেচারা সাধারণদের। যারা সাধারণ, তাদের দুর্ভোগ দুই প্রকারের। বলতে পারে না, সইতেও পারে না।

দেশে দোষারোপের বন্যা। সকাল-বিকেল এর গতি-প্রকৃতি বদলাচ্ছে। আগে শুনতাম মাদ্রাসা-মক্তবের দোষ। দোষ সেখানে পড়া গরিব মানুষের ছেলেপিলেদের। তারপর হঠাৎ পিলে চমকানো ঘটনায় দোষের ধারণা বদলে যেতে দেখে মানুষ।
বলা শুরু হয়ে গেল, অমুক অমুক বড়লোকের ছেলেপিলেদের পড়ানো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মহা দোষ। বাবা, মা, অভিভাবক—দোষ চাপানো হলো তাঁদের ধনসম্পত্তির ওপরও। বড়লোক হওয়ার কারণে সন্তানের প্রতি অবহেলার কথা গাল ভরে বলাবলি হয়। যখন যার মন যা বলছে, মনের কথা ছটফটিয়ে নেমে পড়ছে সাধারণের সমাজে।

ক্রমে বেড়েই চলেছে দোষ ও দোষীর তালিকা। দিনে দিনে তালিকা যত লম্বা হতে থাকবে, সাধারণ জীবনে শঙ্কা, সংশয়ের পরিমাণও বেড়ে চলবে, বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। দোষ, দায় আমাদের সকলের। যা ঘটছে, যেসব প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে তা দীর্ঘদিনের অসচেতনতার ফল। সংস্কৃতিহীনতা, দায়িত্বহীনতা বাড়তে বাড়তে মানুষ হয়েছে বেয়াড়া, লাগামহীন। টিকে থাকার জন্য মানুষ বেছে নিয়েছে স্বার্থপরতা। নিজেরটা বুঝে পেলে অন্যায়কে ন্যায় ভাবতে দ্বিধা নেই। এমন স্বার্থপরতার অবিরাম চর্চায় মানুষের জীবন থেকে মানবিকতা হয়েছে উধাও। গলাধাক্কা খেয়ে খেয়ে ন্যায় রসাতলে গেলেও কারও কিছু যায়-আসে না। ৩৬৫ দিন বহুজন তিন বেলা খায়, ছয় বেলা অন্যের মন্দ চর্চা করে আনন্দ ও গৌরব অনুভব করে। এটিই সবচেয়ে চমৎকার বিনোদন। এমন অস্বাভাবিক কাল সবার গা-সওয়া হয়ে গেছে। মানুষের উপযুক্ততার বিচার পাল্টেছে। অসভ্যতা, অজ্ঞানতা সত্ত্বেও সমাজে বিশেষ হয়ে ওঠা যায়। মানুষ দেখে শেখে, ঠেকে শিখছে। অশেষ অন্যায়, বৈষম্যে হাবুডুবু খেতে খেতে যেকোনো উপায়ে বিশেষ হয়ে উঠতে হবে, শিখেছে মানুষ।

শত অভাব মেনে আপস করে বাঁচা বা টিকে থাকা শিখে নিয়েছে পঞ্চাশের ওপরে বয়স যাদের। যারা তরুণ, বিশ্বজগতের বহু কিছুই তাদের জানা। আরও জানা, দেখার সুযোগ হাতে হাতে, ঘরে ঘরে। পুরোনো যে সমাজে তাদের বেড়ে ওঠা, সেখানে তাদের অস্তিত্ব, অবস্থান সুখের নয়। ভাষা, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং বড়দের ঔদার্যের বদলে রোজ নানা পদের সংকীর্ণতায় বিভ্রান্ত তারা। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অসতর্ক অভিযোগ কিন্তু সে প্রজন্মকে দেখার দৃষ্টিকোণ বদলানো দরকার, সে স্বাভাবিক তাগিদ অনুপস্থিত। পুরোনোরা নতুনদের নতুনই ভাবে। পৃথিবীতে বেশি দিন বাঁচার অভিজ্ঞতায় নতুনদের তারা ভাবে অনভিজ্ঞ। বেছে বেছে তাদের ত্রুটি ধরতে পারে, পরামর্শ দিতে ভালোবাসে। নিষেধ মানতে বলে। গালভরে বলা হয়, নতুন প্রজন্ম। প্রজন্মের নতুনকে, নতুনত্বকে গ্রহণের সামর্থ্য অধিকাংশ জনের নেই।

তরুণ মনে আগ্রহ, বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে, সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান বাড়াতে পারে এমন ভূমিকা, উদাহরণ চারপাশে যথেষ্ট রয়েছে বুক ফুলিয়ে বলা যায় না। সুস্থ চিন্তা, উজ্জ্বল মতাদর্শ, অগ্রসর ধ্যানজ্ঞান, উদ্দীপক কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজেদের অবস্থান দেখতে পারলে সে সমাজকে আনন্দে ও গৌরবে নিজের বলে ভাবতে পারত তারা।

কথা খরচে অনেক মানুষ অকৃপণ। অনেককে বলতে শোনা যায়, ঘাবড়ানোর কী আছে, সাহস কেন হারাবে মানুষ? পৃথিবীর অন্য দেশে কি এমন ঘটনা ঘটছে না? ঘটছে। আমাদের দেশে যা ঘটল, পৃথিবীজুড়েই তেমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটছে। সান্ত্বনা স্বস্তি পাওয়ার মতো ভাবনা নয়। যেখানেই ঘটুক, সেখানকার নিহত আমাদের নিহতে ভেদ নেই। মৃত্যুর শোক একই রকম। কোনো দেশে মানুষ কীভাবে আছে বা থাকে, তার ওপরেই নির্ভর করে জীবিতের অনুভব, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।

এমন বহু দেশ রয়েছে, যেসব দেশে মানুষের দিকে মানুষ অপ্রয়োজনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে স্বাধীনতা খর্ব হয়। অন্যায় বলে বিবেচনা করা হয়। কারও সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। দেশের সঙ্গে না, মানুষের সঙ্গেও না। আলো, হাওয়া, মাটি, অনুভব—সবই আলাদা। মানুষ নামের পরিচয় এক। সমাজ ও নামে এক। সমাজে মানুষের আসন আলাদা, শাসনও আলাদা।

ছেচল্লিশ বছরে দেশবাসী সবাই সবাইকে চিনেছে হাড়ে ও মাংসে। হতাশা উৎপাদনের কারখানা চতুর্দিকে; তবু মানুষ স্বপ্ন দেখে নতুন সংকল্পে, প্রতিজ্ঞায়, নতুন অভিজ্ঞানে দেশ এগিয়ে যাক। সাধারণ মানুষ কখনোই ভোলে না, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণ তারা বয়ে বেড়াচ্ছে। ঋণ শোধ নয়, তাদের মনে আশা, স্বপ্নের বাস্তবায়ন হোক।

ফেসবুকে একটা ঘটনা দেখেছি। আমেরিকার কোনো এক দোকানে যুবক ক্রেতা টুপি পরা মুসলিম দোকানিকে দেখে মহা বিরক্ত। তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে সে। একজন সেনাবাহিনীর সদস্য সে দোকানে ক্রেতা ছিলেন। ঘটনা দেখে এগিয়ে আসেন। সমস্যা কী জানতে চান। তরুণ বলে, দেখো সে একজন মুসলমান, আমাদের দেশে তারা অশান্তি সৃষ্টি করছে। সেনাবাহিনীর সদস্য যুবককে বলেন, আমরা সবাই আমেরিকান। এ দেশে সব নাগরিকের সমান অধিকার। তুমি যদি তার কাছ থেকে জিনিস না কিনতে চাও, অন্য দোকানে যাও। সে অধিকার তোমার রয়েছে। কোনো নাগরিকের সম্মান হরণের অধিকার তোমার নেই।

এই কথা বলার পর দৃশ্যে হাজির হন একজন ভদ্রলোক। তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যের ভূমিকায় গৌরববোধ করেছেন জানান, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেনাবাহিনীর সদস্যকে অবাক হতে দেখা যায়। বলেন, আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি, এতে ধন্যবাদ পাওয়ার কী আছে! তখন জানানো হয় পুরো দৃশ্যটা সাজানো। তারা একটা টেলিভিশন চ্যানেল। জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একজন যুবক অভিনেতাকে দিয়ে মুসলিম দোকানির সামনে অসদাচরণ করানো হয়েছে। সে আচরণে দায়িত্বশীল নাগরিকের কী ভূমিকা, তা দেখানোর জন্য তারা ক্যামেরা পেতে ঘটনাটা ধারণ করেছে। উদ্দেশ্য, জনমনে সংকটে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

আমরা নিজ দেশের মন্দের সঙ্গে অন্য দেশের মন্দের উদাহরণ টেনে আনতে খুব দেরি করি না। অন্য দেশের ভালোর সঙ্গেও মাঝে মাঝে তুলনা টেনে দেখা উচিত। সংকটকালে দায়িত্বশীল বলে পরিচিত সম্প্রদায়ের কেমন ভূমিকা হওয়া উচিত, আর কী দেখে থাকি আমরা। দেখি ক্ষুদ্রস্বার্থের ছড়াছড়ি। মানুষকে মানুষ হিসেবে পাওয়া কঠিন হয়েছে। সর্ব জনস্বার্থের বিষয় ক্ষুদ্রস্বার্থের নিক্তিতে মেপে সঠিক ওজন পাওয়া সম্ভব নয়।

সবার জানা কথা, ব্রিটিশরা দেশভাগ করেছিল বিভাজনের সুবিধাভোগের জন্য। আমরা সে জ্ঞান কদাকার জেনেও উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। ভাগের সুবিধা আমরাও ভোগ করতে চাই। যার যেখানে সামর্থ্য ভোগের দাগ টেনে চলেছি। বিভেদের সুযোগ নিয়ে যারা খেয়ে-পরে দারুণ আছি, তারা সর্বনাশা ধ্যানজ্ঞান বদলাতে চাইব কেন?

বললে লোকসানের ভয়, তাই চালাক মানুষেরা চুপ আছে। অনেকের চালাকি নেই, মন আছে, মনের ভেতর কথাগুলো আছে। অনুভবের কথা। আত্মপ্রতারণা কেন? ছেচল্লিশ বছরে মাত্র ছেচল্লিশ সেকেন্ড যদি দেশের কাজে লেগে থাকি, যদি ছেচল্লিশ ফোঁটা ঘাম দেশ ভালোবেসে দেশের জমিনে ফেলে থাকি, বলার বা অনুভূতি প্রকাশের অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে।

আফজাল হোসেন: অভিনেতা, লেখক ও নির্দেশক।