জনগণই আপনাদের শক্তি

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি যেন না করি ভয়’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমিয় বাণী সমগ্র বাংলাদেশ যেন ধারণ করেছিল। গত শনিবার নজিরবিহীন একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অতিক্রম করেছে। জনসভায় ভাষণদানরত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হয়তো গুরুত্ব না বুঝে প্রাথমিকভাবে লঘু মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এটাই দেখার বিষয় যে বিরোধী দলও এই বিপর্যয় চলাকালে রাজনৈতিকভাবে তেমন আক্রমণ করা থেকে বিরত থেকেছে। সরকারের মুণ্ডুপাত করে নির্দয় বিবৃতির বাণ অন্তত বিপদের সময় নিক্ষেপ করেনি। বিরোধী দল তাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
সবকিছু ছাপিয়ে জনগণ সার্বিকভাবে ও সমষ্টিগতভাবে যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে তার কোনো তুলনা হবে না। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সময়ের মানুষের ইতিবাচক গুণাবলি খতিয়ে দেখতে গিয়ে ১ নভেম্বরের দিনটিকে নিশ্চয় মনে রাখবে। তাই শনিবার শুধুই একটি নিকষ অন্ধকারে হাবুডুবু খাওয়া দিন ছিল না। হাসপাতালে জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়েছিল। রোগীর খাবার রান্না হয়নি। বহু স্থানে হাঁড়ি চড়েনি। হয়তো কোথাও শিশুর জন্য গরম জল, কি দুধ, কি পায়েস গরম করা যায়নি। বহুতল ভবনের লিফট বন্ধ হয়ে কত মানুষ হয়তো অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কবলে পড়েছে। কিন্তু কোথাও মানুষ ধৈর্যহারা হয়নি। কাউকে তাদের আশ্বস্ত করতে হয়নি। তারা নিজে থেকেই শান্ত থেকেছে। নাগরিকেরা সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়েছে। আমাদের নেতারা এবং আমাদের অনেকেই যারা অহর্নিশ কারণে-অকারণে হীনম্মন্যতায় ভুগি, তাদের উচিত হবে মানুষের এই শক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় নতুন করে তাকানো।
আমরা প্রায় সময় বলি, আমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। জাতি হিসেবে আমরা সুশৃঙ্খল হতে পারি না। আমরা বাসে কী ট্রেনে পারাপারি করে উঠি। ব্যাংকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে আমাদের ব্রহ্মতালু জ্বালা করে। আমরা অবশ্য সবে কিছুদিন হয়েছে লাইনে দাঁড়াতে শিখেছি। ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি, সামান্য কিছুতে অযথা উত্তেজিত হওয়া আমাদের মধ্যে আছে। সেই আমরাই, আমাদের এত বড় একটি অঘোষিত জাতীয় দুর্যোগ, কী আশ্চর্য কোথাও ‘উহু’ শব্দটি না করেই পেরিয়ে এলাম।
আমরা আশ্বস্ত হতে পারি, জাতি হিসেবে আমাদের অহংকার করার আছে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। এবং আমরাও পারি। ১ নভেম্বরে দেশের অন্তত কয়েকটি স্থানে ভাঙচুর, অন্তত হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভসহ কিছু বিশৃঙ্খলামূলক ঘটনা ঘটলে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। টানা চার ঘণ্টা ডুবে থাকা ঢাকার কোথাও ছিনতাই-রাহাজানি হয়নি। সবটা মিলিয়ে ভাবতেই এক অনির্বচনীয় আনন্দে উদ্বেল হই। আমরা অন্তত বিশ্বমানের একটি জাতি হিসেবে নিজেদের উন্নীত করতে পেরেছিলাম।
এই প্রশংসা জনগণের। জয়তু মানুষের শুভবুদ্ধি, শুভচিন্তা।
মনে পড়ে, কোনো একটি বিদেশি রাষ্ট্রের ভিসা কর্মকর্তার প্রশ্ন। ভিসার সাক্ষাৎকারে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের প্রধান শক্তি কী। আমার অস্ফুট উত্তর টেনে নিয়ে বললেন, জনগণই আপনাদের শক্তি। যারা ঝড়ে, জলোচ্ছ্বাসে, খরায় মাথা নোয়াবার নয়। সব হারিয়ে আবার নিমেষে উঠে দাঁড়ায়। শনিবারের বাংলাদেশ সেই শক্তি দেখিয়েছে। নিকষ কালো অন্ধকারের এই আরেক অবাক রূপ। এক অপরাজেয় অন্ধকারাচ্ছন্ন রূপসী বাংলা!
আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগছে, গত শনিবারের এই দুর্যোগ দীর্ঘতর হলেও মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেত না। অনিশ্চয়তার প্রহর দীর্ঘ হলেও তারা সরকারের ওপর আস্থা হারায়নি। আসলে আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক দিন বলার মতো আনকোরা কোনো অনবদ্য অর্জনের গল্প সৃষ্টি হয়নি। বহু দিন কোথাও সম্ভবত তেমন কোনো খেলায় আমরা জিতিনি। রাজনীতিতে অসংযম ও অপ্রীতি অবিরত দানাই বেঁধে চলছিল। আমরা ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরে বলেছি, জাতি হিসেবে আমরা বুঝি স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে গেলাম। আমরা আর ঐক্যবদ্ধভাবে তেমন কিছুই করতে পারব না। কিন্তু অভাবনীয় বিপদের মুহূর্তগুলো আমরা শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধভাবে পেরিয়ে এলাম।
এই মাত্র কদিন আগেই লক্ষ্মীপুরে জনতা বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালাল। অনেকগুলো গাড়ি পুড়িয়ে দিল। অথচ কী আশ্চর্য, গোটা দেশ অন্ধকারে ডুবে থাকল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ আমরা কোথাও আইন নিজের হাতে তুলে নিলাম না। এ রকম পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার নজির বিশ্বে বিরল নয়। তবে ঠিক এ ধরনের ব্ল্যাকআউটের মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ উন্নত বিশ্বে যে একেবারে বিরল তা নয়। নিরাপত্তাব্যবস্থা কড়াকড়ি বা রেড অ্যালার্ট জারি ছাড়াই বাংলাদেশ শান্ত ও স্থির থেকেছে।
এমন একটি জাতীয় বিপর্যয়ে আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেন সচল হতে পারল না, সেটা সরকার নিশ্চয় খতিয়ে দেখবে। বিদ্যুৎসচিবের বরাতে যখন ‘ধৈর্য ধরার’ খবর এল, তখন রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। কেন বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতি ঘণ্টা অন্তর বুলেটিন প্রকাশ করতে অপারগ থাকল, তাও দেখতে হবে। কোনো মুখপাত্র থাকাই সংগত ছিল। তবে কী উচিত ছিল আর কী হলো না, সেসব বলে ভারাক্রান্ত হতে চাই না। বরং এতেও আমরা দুর্দমনীয়, শত প্রতিকূলতায় কোনো কিছুতেই হার না-মানা গণশক্তির স্ফুরণ দেখি। মানুষের ধৈর্যচ্যুতি কিছুতেই ঘটেনি। সরকার জনগণকে ধন্যবাদ দিতে পারে। কারণ জনতা বিপদে সত্যিকারের বন্ধুর মতো পরিচয় দিয়েছে। দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিতে পেরেছে। দেশের কোথাও নাশকতামূলক কিছু ঘটেনি। ব্ল্যাকআউট নিয়ে যতটুকু জল্পনা-কল্পনা হয়েছে, সে জন্য মানুষকে দায়ী করা যাবে না। বিদ্যুৎ না থাকায় অন্ধকার নেমেছিল। কিন্তু তথ্য প্রকাশ না পাওয়ার কারণ সে অন্ধকারকে গাঢ় করেছিল।
আর সার্বিকভাবে সরকারেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। দেশব্যাপী একটি এত বড় দুর্যোগ তারা সহজে কাটাতে পারল। একে খুব বড় ধরনের কোনো মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হতে দেয়নি। এই দুর্যোগ কাটাতে বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারের যেখানে যিনিই নিষ্ঠাভরে ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরা এই সময়ের নায়ক। তাঁদের অভিবাদন। তাই শনিবার আমরা কেবল অন্ধকারেই ডুবে ছিলাম না। আমরা জাতিগতভাবে একটি পরীক্ষাও দিয়েছি। আর তাতে আমরা সবাই জিপিএ ফাইভ পেয়েছি। এভাবে আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি আলোকিত অধ্যায় সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমরা আমাদের জাতীয় সংহতি ও ঐক্যের মুকুটে আরেকটি সোনালি পালক যুক্ত করতে পেরেছি।
শনিবারের বাংলাদেশ তাই কেবল অন্ধকারে ডুবে ছিল না। ছিল এক বিরল আলোকমালায় উদ্ভাসিত।